কীর্তিনাশা বাঁওড়ে অতিথি পাখি না আসার জন্য আমরাই (মানুষ) দায়ী
ইয়াসিন আযীয
এবারের শীত মৌসুমে শরীয়তপুর শহরের অতি সন্নিকটে—চৌরঙ্গী মোড় থেকে কয়েক মিটার পশ্চিমে কীর্তিনাশা বাঁওড়ে অতিথি পাখি না আসার জন্য আমরাই (মানুষ) দায়ী বলে মনে করি। অতীতে শরীয়তপুর জেলা পালং নদীর তীরে অবস্থিত ছিল। পালং নদী পরবর্তীতে তার গতিপথ পরিবর্তন করে অনেকটা পশ্চিম দিক দিয়ে প্রবাহিত হলে শরীয়তপুর শহরের পাশে বেপারী পাড়ায় লঞ্চ/স্টিমার ঘাটের আশেপাশের এলাকায় বাঁওড়ের সৃষ্টি হয়। আমরা জানি সাধারণত নদীর গতিপথ বদলে যে অশ্বক্ষুরাকৃতির আবদ্ধ জলাশয় সৃষ্টি হয় তাকে বাঁওড় বলে। পালং নদী তার গতিপথ পরিবর্তন করায় এই বাঁওড়ের সৃষ্টি। মজার বিষয় হলো পালং নদী গতিপথ পরিবর্তন করল এবং এর থেকে সৃষ্ট বাঁওড়ের নাম পালং বাঁওড় না হয়ে হলো কীর্তিনাশা বাঁওড়। এটা এই লেখার প্রাসঙ্গিক বিষয় না। এই বিষয়ের কিছুটা ব্যাখ্যা আমি দিয়েছি আমার নদী বিষয়ক ‘শৈশবের নদী কীর্তিনাশার খোঁজে’ গদ্যে। বলা চলে পালং নদীই বর্তমানে ‘কীর্তিনাশা নদী’ নাম ধারণ করেছে। ঠিক একই ভাবে বাঁওড়...।
এবার মূল বিষয়ে আসা যাক। প্রতিবছর শীতে শরীয়তপুর শহরের অদূরের
কীর্তিনাশা বাঁওড়ে প্রচুর অতিথি বা পরিযায়ী পাখি আসে। অতিথি বা পরিযায়ী পাখি কোথা
থেকে, কোন কোন ধরণের এবং কেন আসে তা আমরা প্রায় সকলেই অবগত। তবে হয়তো আমরা অনেকেই
জানি না যেটা, তা হলো অতিথি বা পরিযায়ী পাখিরা বিজ্ঞান মেনে
বা বিজ্ঞানের সূত্র মেনে দূর দূরান্ত থেকে উড়ে আসে। পাখিদের এই দীর্ঘ ভ্রমণের ক্ষেত্রে বিজ্ঞানের সূত্রের ব্যবহার বিজ্ঞানী এবং পাখিবিদদের বিস্মিত করেছে। যাই হোক কীর্তিনাশা বাঁওড়ে আসা অতিথি বা পরিযায়ী পাখির পরিমান প্রচুর কিন্তু এর মধ্যে বালিয়া হাঁস
অন্যতম। অতিথি বা পরিযায়ী পাখি দেখতে শহরের মানুষজন বিকেল বেলা বেপারীপাড়া মোড়ে
ভিড় করত। অতিথি বা পরিযায়ী পাখির কিচিরমিচির এবং ওড়াউড়িতে নয়নাভিরাম দৃশ্যের এবং
সুমধুর শব্দ ব্যঞ্জনার সৃষ্টি হতো। এসব পাখি আমাদের বাস্তুসংস্থান এবং
জীববৈচিত্র্যের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু দুঃখের বিষয় এই যে, এ বছর উল্লেখ
করার মতো তেমন অতিথি বা পরিযায়ী পাখি কীর্তিনাশা বাঁওড়ে আসেনি। এর জন্য
মোটা দাগে আমরা মানুষরাই দায়ী বলে মনে করছি। এবছর অতিথি বা পরিযায়ী পাখি না আসার
কারণ খুঁজতে বাঁওড় পাড়ের মানুষজনের সাথে কথা বলেছি। অবশেষে এর জন্য (অতিথি বা
পরিযায়ী পাখি না আসা) আমি কতগুলি কারণ নির্ধারণ করেছি। সেগুলো হচ্ছে—শরীয়তপুর
আস্তে আস্তে একটি বড়ো এবং ব্যস্ত শহরে রূপান্তরিত হচ্ছে। নতুন নতুন সরকারি ও
বেসরকারি বিল্ডিং এবং স্থাপনা তৈরি হচ্ছে। এ সকল বিল্ডিং ও স্থাপনার সুয়ারেজ
লাইনের ময়লা-আবর্জনা শেষ পর্যন্ত কীর্তিনাশা বাঁওড়ে এসে পড়ছে। অপরদিকে শরীয়তপুর
শহরের আশেপাশের সমস্ত খালগুলি ভরাট এবং দখল হয়ে যাওয়ায় কীর্তিনাশা নদীর সাথে
বাঁওড়ের সংযোগ অনেকটাই বন্ধ হয়ে গেছে। যার দরুন বর্ষা মৌসুমে বাঁওড়ে নতুন পানি
প্রবেশ করতে পারছে না। ফলে বাঁওড়ের আওতাভুক্ত পানি, মাটি তথা পরিবেশে দূষণের মাত্রা
দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। পাখির খাবার কমে যাচ্ছে। গন্ধযুক্ত নোংরা পানিতে পাখি ও
মাছ টিকতে পারছে না। এক সময় জেলেদের এখানে মাছ ধরতে দেখা যেত। এখন আর দেখা যায়
না। কচুরিপানাসহ বিভিন্ন আগাছায় ভরে আছে বাঁওড়। পানির সাথে ময়লা গিয়ে ভরে যাচ্ছে
এবং নাব্যতা হারাচ্ছে। শরীয়তপুর টু চন্দ্রপুর রাস্তাটির
কীর্তিনাশা নদীর পাড়ের সামান্য কিছু অংশ দীর্ঘদিন পূর্বে ধসে কীর্তিনাশা নদীতে
বিলীন হলেও প্রশাসনের বিভিন্ন সংস্থার অবহেলা এবং সমন্বয়হীনতার অভাবে যানবাহন
চলাচল বন্ধ রয়েছে অনেকদিন ধরে। ফলে বাঁওড়ের পাশ দিয়ে চৌরঙ্গী টু স্বর্ণঘোষের
রাস্তাটিতে গাড়ি চলাচল পূর্বের তুলনায় অ-স্বাভাবিক ভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। যার দরুন
গাড়ি এবং গাড়ির হর্নের শব্দে পাখিরা ভয় পেয়ে যায়। এছাড়াও বাঁওড়টি সরকারি বা দেশ ও
জনগণের সম্পত্তি হওয়া সত্বেও চারপাশ থেকে একটু একটু করে দখল হয়ে যাচ্ছে। সবচেয়ে
গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে বাঁওড়ের পশ্চিম পাশে একটি বাড়িতে নানারকম রঙিন বাতি দিয়ে
আলোকসজ্জা করা হয়েছে যা রাতের বেলা থেকে থেকে জ্বলে নিভে। ফলে রাতে দূর থেকে রঙিন
বাতিগুলি ঝিকমিক করতে দেখা যায়। তাই পাখিরা ভয় পেয়ে যায়। যার ফলশ্রুতিতে অতিথি
পাখিরা কীর্তিনাশা বাঁওড়ে এ-বছর, ভয়ে দিকভ্রান্ত হয়ে তাদের আতিথেয়তা নেয়নি হয়তো।
ওপরে উল্লিখিত বিষয়গুলোর প্রতি শরীয়তপুর জেলা প্রশাসনের দৃষ্টি আকর্ষণ
থাকবে। যাতে করে কীর্তিনাশা বাঁওড়ের চারপাশটা দখলমুক্ত করা হয়; আগাছা পরিষ্কারের
উদ্যোগ গ্রহণ করা হয় এবং রঙিন বাতি ব্যবহারে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়। তবেই আগামী
বছর হয়তো পাখিরা ফিরে আসবে পূর্বের ন্যায় এবং সৃষ্টি হবে নয়নাভিরাম দৃশ্যের।
অতিথি বা পরিযায়ী পাখির অন্যতম বিচরণক্ষেত্র বা অভয়ারণ্যখ্যাত জাহাঙ্গীর নগর ইউনিভারর্সিটিতেও সম্প্রতি বছরগুলিতে অতিথি বা পরিযায়ী পাখি কমে গিয়েছিল। যার পরিপ্রেক্ষিতে ভাবিয়ে তোলে পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী, শিক্ষক এবং অন্যান্যদের। কুটিপানা এবং টোপাপানা বালিয়া হাসের মতো অতিথি বা পরিযায়ী পাখির প্রধান খাদ্য। জাহাঙ্গীর নগর ইউনিভারর্সিটির জলাশয়গুলোতে কুটিপানা এবং টোপাপানা কমে যাওয়ায় অন্যত্র থেকে এসব পানা এনে দেওয়া হয় ইউনিভারর্সিটির জলাশয়গুলোতে। ফলে এবছর বাড়তে থাকে অতিথি বা পরিযায়ী পাখির পরিমান। শুধু তাই নয় শীতের শেষেও পাখিদের ইউনিভারর্সিটির জলাশয়গুলোতে প্রচুর পরিমান দেখতে পাওয়া যাচ্ছে।কীর্তিনাশা বাঁওড়েও কুটিপানা এবং টোপাপানার ঘাটতি দেখা যাচ্ছে। তাই কীর্তিনাশা বাঁওড়ের ক্ষেত্রেও ইউনিভারর্সিটির জলাশয়গুলোর মতো অনত্র থেকে কুটিপানা এবং টোপাপানা এনে দেওয়া যেতে পারে—অতিথি বা পরিযায়ী পাখিদের ফিরিয়ে আনার জেন্য।
প্রশাসনের নিকট দীর্ঘমেয়াদের জন্য মোটাদাগে একটা প্রত্যাশা এবং
পরামর্শ থাকবে—বছরের অন্য সময়ের জন্য কীর্তিনাশা বাঁওড়কে একটা ভ্রমণ স্পটে
রূপান্তরিত করা যেতে পারে। শরীয়তপুর জেলার একটি অন্যতম ভ্রমণ স্পট হতে পারে কীর্তিনাশা
বাঁওড়। শরীয়তপুর জেলা শহরের আশপাশের বসবাসরত মানুষের অবকাশ যাপন এবং প্রকৃতির
কাছাকাছি যাওয়ার কোনো মনোরম লোকেশন বা ভালো কোনো স্থান নেই। ফলে তারা মাদারীপুরের
শকুনি লেকসহ বিভিন্ন স্থানে সময় কাটাতে যায়। এক্ষেত্রে কীর্তিনাশা বাঁওড়ের সীমানা
নির্ধারণ করে, খননের ব্যবস্থা করা যেতে পারে। নাব্যতা ফিরিয়ে এনে পরিবেশ বান্ধব
উপায়ে ব্যবহার উপযোগী করে নৌকা ভ্রমণ ও রেস্তোরাঁর ব্যবস্থা করা যেতে পারে।
এতে করে শরীয়তপুর শহরের মানুষের অবকাশ যাপনের একটি ভালো সুযোগ তৈরি হবে এবং
সরকারেরও আয়ের একটা উৎস বৃদ্ধি পাবে।
এখানে বলে রাখা ভালো গতবছর তৎকালীন জেলা প্রশাসকের উদ্যোগে শরীয়তপুর ১০০ শয্যা বিশিষ্ট হাসপাতালের পশ্চিম এবং শিল্পকলা মাঠের দক্ষিণ পাশে ‘শরীয়তপুর পার্কের’ উদ্বোধন করা হয়। যার ফলশ্রুতিতে শরীয়তপুর শহর এবং আশেপাশে বসবাসরত লোকজন বিকেলে বাচ্চাদের খেলাধুলার এবং সুন্দর সময় কাটানোর একটা স্থায়ী স্থান পেয়েছে। ঠিক এভাবেই কীর্তিনাশা বাঁওড়ের সীমানা নির্ধারণ করে ভরাট হয়ে যাওয়া উঁচু স্থানে বিভিন্ন ধরণের ফুল-ফলের গাছ লাগানো, চারপাশে রাস্তা এবং ওয়াকওয়ে তৈরি করে অবৈধ দখল যেমনিভাবে ঠেকানো যেতে পারে। ঠিক তেমনিভাবে যে পরিমাণ জায়গা জুড়ে এখনো পানি আছে সেখানে নৌকা ভ্রমণ এবং মাছ চাষের ব্যবস্থা করা যেতে পারে।