ঈদ সংখ্যা ।। ০৯ জুন ২০২৫

ঈদ সংখ্যা ।। ০৯ জুন ২০২৫

হানিফার গরু

সুলতান মাহমুদ

 

প্রতি বছরের ন্যায় এ বছরও নদী তীরে বড় একটি জাহাজ বাধা রয়েছে। গাঁয়ের ছোট ছোট ছেলে মেয়েগুলো সারাক্ষণই জাহাজের পাশে ঘুরঘুর করছে। জাহাজটি ভোলা থেকে এসেছে। আরিচা হয়ে রাজশাহীর দিকে যাবে। মাঝখানে যাত্রা-বিরতি। পুরো জাহাজটি কয়লা ভর্তি। জাহাজের খালাসি ভালো মানুষ। সে বড় একটি সিঁড়ি পেতে দিয়েছে। ছেলেমেয়েরা সিঁড়ি দিয়ে খুব সহজেই জাহাজের ভিতরে ঢুকতে পারছে। অবশ্য ছেলে বুড়ারাও এক্ষেত্রে পিছিয়ে নেই।  হানিফার এদিকে খুব একটা খেয়াল নেই। সে জাহাজের পাশে খোলা মাঠে তার একমাত্র গরুটাকে ঘাস খাওয়াচ্ছে।  এ বছর প্রচুর বৃষ্টি হয়েছে। মাঠের ঘাসগুলো লাফিয়ে লাফিয়ে বড় হয়ে গেছে। হানিফা মহা উৎসাহে সে ঘাস তার গরুটাকে খাওয়াচ্ছে। সামনে কোরবানির ঈদ। হানিফা ঈদে গরুটাকে বিক্রি করতে চায়। হানিফার গরুটা কিছুটা রোগাটে। দেহের গড়ন তার মতই লিকলিকে। এত স্লিম গরু তা দেখতে যত স্মার্টই হোক কোরাবানির বাজারে দাম যে বেশি পাওয়া যাবে না, সে বিষয়টা পুরো নিশ্চিত। হানিফা চিন্তা করছে কিভাবে গুরুটাকে মোটা করা যায়। সে মাঝে মাঝে বাংলা সিনেমা দেখে। সিনেমার নায়িকারা ভয়ংকর স্বাস্থ্যের অধিকারী! ওদের কাছ থেকে গরু মোটাতাজাকরণের পদ্ধতিটা শিখে নিতে পারলে ভালো হতো। কিন্তু সেটাতো সম্ভব না। গরুর পিছনে থাকতে গিয়ে হানিফার এখনো বিয়ে করাটা হয়ে উঠেনি। এ বিষয়ে মাঝে মাঝে গাঁয়ের দুষ্ট ছেলেগুলো তাকে টিপ্পনি কাটে। তখন সে একটা অদ্ভুত জবাব দেয়। পাঠককুলের জ্ঞাতার্থে বিষয়টা তুলে ধরছি—‘কিয়ের মিয়া বিয়া করুম? গরুর নাই ঘাস, মুরগের নাই আদার, হাসে করে প্যাঁ প্যাঁ!’

 

নদীর তীর ঘেঁসে হাসু দালালকে হেঁটে যেতে দেখা যায়। তিনি এ এলাকার বিখ্যাত গরুর দালাল। গরু কেনাবেচার মাঝখানে কোথা থেকে যেন তিনি হঠাৎ উদয় হন। তাকে কমিশন না দিয়ে গরু বেচা কঠিনই বটে। লোকটার চেহারায় বিশেষ কোনো ব্যপার আছে যেটা গরুকূলের মনে বিশেষ ভীতির সৃষ্টি করে। তবে গো-বিশেষজ্ঞ হিসেবে কিছুটা হলেও তার সুনাম ছড়িয়ে পড়েছে। তাই অনেকেই তার পরামর্শ মোতাবেক কাজ করে। হানিফা হাসু দালালকে ডাকে। ‘মিয়া ভাই কই যান? একটু এদিকে আহেন।’ হাসু দালাল তার প্রকান্ড ভুড়িটা দোলাতে দোলাতে এগিয়ে আসে। বেটার ভুড়িতে গো মাংস থেকে আগত কেজি বিশেক চর্বি আছে!

কি খবর হানিফা তোমার দেখা সাক্ষাৎ নাই।

এইতো আছি মিয়া ভাই।

তো কোরবানির ঈদে এইবার গরু বেচবানি?

হ মিয়া ভাই এই যে ঘাস খাইতাছে এইডাই বিক্রি করুম।

এইডাতো একদম লিকলিক্যা।

হ মিয়া ভাই চিন্তা করতাছি কয়েদিন আলু খাওয়াইমু।

আরে ঐ সব আলু টালুতে কাম অইব না।

তয় কি করন লাগব?

গইন্যা গইন্যা উনিশটা ইকজেকশন দিতে অইব আর কয়ডা টেবুলেট খাওয়াইতে অইবদেখবি গরু তোর ফুইল্যা বেলুন অইয়া যাইব।

মিয়া ভাই এইসব কই পাইমু।

হেইডা নিয়া তোর চিন্তা করণ লাগব না, তয় আমার কমিশনডা ঠিক রাহিস। আর হুন রহিম মাষ্টার তোরে গরু নিয়া উল্ডা পাল্ডা পরামর্শ দিতে পারে।

দিলে কি করুম মিয়া ভাই।

বলদ নাকি কি করবি মানে? এক কান দিয়া হুনবি আরেক কান দিয়া বাইর কইরা দিবি।

ঠিক আছে মিয়া ভাই।

হাসু দালালের গমন পথের দিকে হানিফা এক দৃষ্টে তাকিয়ে থাকে। হাসু দালাল এক সময় গুরু পালন করত। তবে তার কিছুটা বদরাগী স্বভাব ছিল। গুরুরাও যে তারই মতো একটি প্রাণী, গরুদেরও যে কিছু অধিকার আছে সেটা সে বুঝতে চাইত না। গুরু আইনের বিভিন্ন ধারার প্রতি বৃধাঙ্গুলী দেখিয়ে সে প্রায়ই গরুদের উপর সপাং সপাং পাইচনের বাড়ি চালাত। এক বার তো কন্নি দিয়ে একটা গরুর মাজাই ভেঙে ফেল্ল। সে আরেক এলাহি কান্ড। পরে তড়িঘড়ি করে গরুটাকে জবাই  দেয়া  হয়েছিল।

 

সবুজ পাড়ের শাড়িতে ময়নাকে দেখা যায়। মেয়েটি কুচকুচে কালো, লিকলিকে তার গড়ন। সূর্যের আলো তার কালো শরীরে প্রতিফলিত হচ্ছে। সে কলসি কাখে নদিতে পানি নিতে এসেছে। এই ভর দুপুরে ময়নাকে দেখে হানিফার মনে কী রকম যেন একটা অনুভূতির সৃষ্টি হয়। সে অব্যক্ত কথা প্রকাশে সে বাঁশিতে সুর তোলে। ময়নার চলার গতি থামে। সে এক দৃষ্টিতে বাঁশির দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে থাকে। সুর থেমে যায়।

রাখাল বাঁশি থামাইলা যে বড়?

কী করুম, শোনারতো কেউ নাই?

কী যে কওঐ যে জংলার গাছ, আসমানের মেঘ, গাঙের পানিহগলতেই তোমার বাঁশির সুর শোনতাছে।

আমিতো সবার লইগা বাজাই না। কিন্তু যার লাইগা বাজাই, হে তো শোনে না।

রাখাল মনে তোমার রং লাগছে।

জানি না। তয় রংয়ের মিস্ত্রির তো দেখা নাই। শুনে ময়না হাসে।

হাসলা যে বড়?

কেন হাসতে মানা নাকি?

তো এই একটা গরু নিয়া আর কতকাল রাখাল।

ভাইগ্য থাকলে এই একটাই বরকত দিব ময়না।

তুমিতো রাখাল হাসের কিচ্ছা মনে করায় দিলা।

কিরম কিচ্ছা?

ঐ যে এক লোকের একটা হাস আছিল। হেয় স্বপ্ন দেহে হাসে ডিম পারব, ডিম থেইক্যা আরো হাস অইব এক সময় হে বড়লোক অইব তোমার অবস্থাতো সেইরকম।

কি যে কও তুমি।

আমি ঠিকই কইছি। ময়না ধীরপায়ে চলে যায়।

হানিফার মা মহা টেনশনে আছে। সে কিছুতেই গরুকে ইনজেকশন দিতে চাচ্ছে না। হানিফাও নাছোরবান্দা।

মা অহন বেবাক মাইনষেই ইনজেকশন দিয়া গরু মোটা করে।

বেবাক মাইনষে করলেও আমগো করণ দরকার নাই।

এমন রোগা গরু পরে ইনজেকশন দিলেতো মইরাই যাইব। তুই হেই কিচ্ছাডা জানস না।

কোন কিচ্ছাডা মা?

ঐ যে একটা ব্যাঙ ধান ক্ষেতের আইলে বড় একটা ষাড় দেখছিল, পরে তার মায়ের কাছে গিয়া কয় আমি আইজ অনেক বড় একটা ষাড় দেখছি।

মা কত কয় কত বড় ?

ব্যাঙের বাচ্চা কয় অনেক বড়।

মা তখন পেট ফুলায়। বাচ্চা কয় আরো বড়। মা আরো বেশি কইরা ফুলায়। বাচ্চা কয় আরো বড়। একসময় আরো ফুলাইতে গিয়া পটাস কইরা ব্যাঙের পেট ফাইটা যায়। ইনজেকশন দিতে গেলে তোর গরু ও এইরম ফুইট্টা যাইব।

মা যে কী কও, কই গরু আর কই ব্যাঙ! বাদ দেও দি ঐসব ফালতু চিন্তা ভাবনা।

আমি ফালতু কতা কইনা পরে টের  পাবি।

এমন সময় রহিম মাষ্টারের গলা শোনা যায়। মাষ্টারের গলা শুনেই হানিফার মা ঘরের ভিতরে ঢুকে যায়। হাসু দালালের বুদ্ধিতে হানিফা কোচরে কিছু তুলা রেখেছিল। মাষ্টারের গলা শুনেই সে কানে তুলা গুঁজে দেয়। মাষ্টার যা বলে বলুক হানিফা তা শুনতে চায় না।

 

হানিফা কালিখোলা গরুর হাটে এসেছে গুরু বিক্রি করতে। মুখে তার হাসি, হাতে রঙিন বাঁশি। সুরেলা বাঁশি বাজিয়ে ক্রেতা সাধারণকে তার দিকে আকর্ষণ করার চেষ্টা করছে। হানিফার গরু ফুলে ফেঁপে ছোটখাটো একটা হাতি আকৃতি ধারণ করেছে। অথচ গত এক মাস আগেও এটা ছিল লিকলিকে একটা বাছুর আকৃতির। আলাদিনের ম্যাজিক হানিফার ম্যাজিকের কাছে ফেল মেরেছে! এজন্য হানিফাকে অবশ্য কম কষ্ট করতে হয়নি। হাসু দালালকে মোটা অংকের টাকা দিয়ে ইনজেকশন ও গরু মোটাতাজাকরণের টেবুলেট আনিয়েছে। গত কিছু দিন যাবত সে গরুকে প্রতিদিন একটা করে ইনজেকশন দিয়েছে সাথে গরুর টেবুলেটতো ছিলই। যে গরু বিশ হাজারে কেউ কিনত না, তার দাম এখন আশি হাজার টাকায় গিয়ে ঠেকেছে! আলাদিন হানিফার গরু দেখলে নির্ঘাত হার্টফেল করত! ইতিমধ্যে কয়েকজন গ্রাহক পঞ্চাশ হাজার টাকা দামাদামি করেছে কিন্তু হানিফা তাদের কোনো পাত্তাই দেয়নি। তার এক কথা- ভাই এইডা হইল খাঁটি অস্ট্রেলিয়ান গরু এইসব দাম শোইনা আমার গরুডাকে খামোখাই শরম দিতাছেন। বিদেশী গরুতো এর লজ্জা শরম একটু বেশি।

বেলা বাড়ার সাথে সাথে গরুর বাজার ধীরে ধীরে জমে উঠছে। হাসু দালাল হাসি হাসি ভাব নিয়ে পুরো বাজারটা বার বার চক্কর দিচ্ছে। সকাল থেকে ইনকামও খারাপ হয়নি। তাছাড়া তার কল্যাণে এ বছরও কিছু ভেজাল মোটা গরু এসেছে যা থেকে ভালো একটা কমিশন পাওয়ার ও সম্ভাবনা আছে। গরুর হাম্বা রব আর বেপারীদের চিত্কার মিলে এক অভাবনীয় পরিবেশের সৃষ্টি হয়েছে। হানিফার গরুর পাশে ভীর দেখে হাসু দালাল এগিয়ে যায়। ক্রেতারা ষাট হাজার টাকার বেশি দেবেনা কিন্তু হানিফার এক কথাএই অস্ট্রেলিয়ান গরুর প্রতি এই দাম কইলে ইনছাফ হয় না। হাসু দালাল উপযাচক হিসেবে মাঝখানে উপস্থিত হয়। ভাই খাঁটি মাল একটু বেশি দাম দিলেও ঠকবেন না। ক্রেতারা একটু আমতা আমতা করে। আরে ভাই কুরবানি হইতাছে গিয়া আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনসেইখানে এত হিসাব করলে চলব। কিন্তু ...। আর কিন্তু কিন্তু কইরেন নানেন আর পাঁচ হাজার কম দিয়েন। হানিফা গরুর রশি খুলতে যায়। তার মুখে হাসির ঝিলিক দেখা যায়। পঁচিশ হাজার টাকার গরু পঁচাত্তর হাজার টাকায় বিক্রি, বিষয়টা স্বপ্নের মত লাগে তার কাছে।

 

হঠাৎ গরুটি ভয়ংকর শব্দে ডেকে উঠে। হানিফা কিছুটা হতচকিত হয়ে যায়। গরুটার মুখ দিয়ে ফেনা বের হতে লাগল। মিয়া ভাই কী অইল? গরুতে এমন করে ক্যান? হঠাৎ প্রচণ্ড শব্দ তুলে গরুটি মাটিতে পড়ে তপড়াতে থাকে। ক্রেতারাও হতচকিত হয়ে গেছে। কী মিয়া অস্ট্রেলিয়ান গরুর এই অবস্থা কেন? ততক্ষণে গরুর অবস্থা আরো কাহিল। তার পেটটা আরো ফুলে উঠেছে। মনে হয় ফেটেই যাবে। গুরুর দু চোখ দিয়ে ঝর ঝর করে পানি পড়ছে। হাসু বিড় বিড় করে বলে হানিফারে ইনজেকশন বেশি মাত্রায় দিয়া ফালাইছস। কিছুক্ষণ তপড়াতে তপড়াতে গরুটি মারা যায়। হানিফা হাউমাউ করে কাঁদছে। হাসু দালাল সুযোগ বুঝে সটকে পড়ছে। চারপাশে কৌতূহলী মানুষের ভিড় বাড়ছে। নিথর হয়ে পড়ে আছে গরুটি। তবে তার চোখ দুটি খোলা। সে চোখ দিয়ে লোভী মানুষদের প্রতি ঝরে পড়ছে অবিরাম ঘৃণা।

 

কুরবানি

মাহমুদ নোমান


তোমাকে পেলে

হয়তো কুরবানি দিতাম;
তোমাকে খুঁজতে খুঁজতে
মনের পশু

বনে চলে গেছে,
কতবার আমার বাড়ির দিকে চেয়েছে
পথে যেতে নাকি ডেকেছে
একইরকম ডাকে
নামহীন,
খুঁজতে খুঁজতে
আমাকে পেলে,
হয়তো কুরবানি দিতাম

 

সুন্দরী গোলাপ
শ্যামসুন্দর দেবনাথ


ও-কে ‘কলি’ বললাম, ও ফুল হয়েই ফুটলো
নাম দিলাম ‘গোলাপ’
—‘গোলাপ ফুল’ হলো।

গোলাপ ফুলকে ‘সুন্দর’ বলায় সে সুন্দরী হলো
ছুঁতে গেলে কাঁটা ফুটালো, হাতেই উঠে বসলো
প্রথম ‘প্রেম নিবেদনের প্রতীক’ মর্যাদা পেলো
ভালোবাসারা ও-কে ‘উপহার’ মান্যতা দিলো।

অতিথি বরণে ‘লালগোলাপ-শুভেচ্ছা’ সমাদৃত
বন্ধুত্ব উন্মেষে ‘প্রীতি-স্মারক’ গোলাপই বিধৃত
শুভদৃষ্টির প্রত্যূষে গোলাপই করপুটে জোটে
ক্রমশঃ মলিন; প্রেমের সুগন্ধে নিত্যই ফোটে।

মা-বাবা বড়ো আদরে নাম রাখতো ‘গোলাপী’
এখন ব্যাকডেটেড; প্রেমের রং লাল, গোলাপি?
আপডেটে ডাকনাম
স্বপ্নের ব্যঞ্জনায় ‘রোজি’
হৃদয় ফুটলেই ফুল, মনের মানুষ খোঁজাখুঁজি।

কাব্যে
—‘‘তোমার গোলাপগালে একছোঁয়া চুমো,
‘আকাশ জোড়া চুমো’; রাত গভীর, এখন ঘুমো।’’

 

বান ডেকেছে চাঁদের আলোয়
ফজলুল হক

চাঁদের আলোয় বান ডেকেছে, এই
ইচ্ছে করে প্রেমের জলে শরীর ধুয়ে নেই।
ঢেউ উঠেছে পরাণ জুড়ে দারুণ জোৎস্নাবানে,
তাকে তখন ডাক দিয়েছি প্রণয় আহ্বানে।
সখি তখন ঈষৎ লজ্জ্বানত,
মনের মাঝে শঙ্কা জাগে কতো !
একটা আকাশ তাকিয়ে আছে অই,
আমি এখন কেমন করে তোমার পাশে রই ?

আমি বলি এসো সখি নদীর জোয়ার দেখি
নদীর জলে তোমার আমার যুগল নামটি লিখি।
জোয়ার বহে গহন গহীন পরাণ নদীর জলে,
তখন তাকে ডাক দিয়েছি ভালোবাসার ছলে।
সখি তখন আঁচলে মুখ ঢাকে,
মনের মাঝে ভয়ের ছবি আঁকে।
হাজার তারা দেখছে চেয়ে, তাই
সবার মাঝে কেমন করে তোমার কাছে যাই ?

আকাশ দেখুক, তারা দেখুক, দেখুক চাঁদের আলো
সখি তোমার শঙ্কা মুছো যদিই বাসো ভালো।
আকাশ জুড়ে জোৎস্নাধারা অবাক চেয়ে রয়
চন্দ্রালোকে যাচ্ছে ভেসে সকল পরাজয়।

মনের পশু কোরবানি দাও

খান মেহেদী মিজান

 

হালাল হলেও করোনা শুধু
বনের পশু কোরবানি
সাথে সাথে কোরবানি দাও
মনের পশু সবখানি।
নাইবা পারো নাইবা করো
সবার ভালো উপকার
চিন্তা কাজে করোনা কারও
অকল্যাণ বা অপকার।
মানুষ হয়ে কেন করো
মানুষের চরম ক্ষতি
মুক্তি কিন্তু পাবেনাকো
হিংসা থাকলে একরতি।

ঈদের পরে বৃষ্টি আসুক
সুপান্থ মিজান

রোজার ঈদের আগে পরে
চাই না বৃষ্টি চাই না,
এই সময়ে বৃষ্টি হলে
পাই নারে সুখ পাই না।

কোরবানী ঈদ এলে তবে
বৃষ্টি সবাই চাই,
কোরবানি শেষ বৃষ্টি এলে
খুব উপকার পাই।

বৃষ্টি স্রোতে যায় ধুয়ে যায়
রক্ত-আবর্জনা
মনের কালি দূর করে দিই
জানে সর্বজনা।

রোগজীবাণু
দূষণ মুক্তির
জন্য বৃষ্টি আসুক,
সুস্থ পরিবেশে সবাই
খুশির হাওয়ায় ভাসুক। 

 

কুরবানি
রফিক ওসমান

ইছব, ইসমাঈল দু’ভাই মিলে
যাত্রা করে শুরু
ওদের বাবা আকুব আলী
কিনবে মস্ত গরু।

ছোটো ছেলে ইছব বলে
লাল গরুটা সেরা
মেঝো ছেলে ইসমাইল আছে
ঘাড়টা করে তেড়া।

বড়ো ছেলে ওসমান বলে
কি হয়েছে বল
লাল কালো কোনটা নেবো
দেখি আগে চল্।

কুরবানি হয় ছাগল গরু
উট দুম্বা জানি
এসো করি মনের পশু
এই ঈদে কুরবানি।

 

মায়া
খান নজরুল ইসলাম


যদি ভালোবেসেই থাকো
জড়িয়ে রেখো গুল্মলতার মতো
সকাল বিকাল শূন্যলতা যেমন...
বালাই থেকে মুক্ত রাখে মায়ায়।

যদি ভালোবেসেই থাকো
জড়িয়ে রেখো ভোরের শিশির হয়ে
আকাশটাকে বিন্দু বিন্দু মেঘ...
গভীর তাপে ঢেকে রাখে ছায়ায়!

যদি ভালোবেসেই থাকো
রাখবো তোমায় গভীর নিরাপদে
তোমার বুকের ঝড়, বৃষ্টি, রোদ...
ভয়ানক সব আপদ, বিপদ, শোক
সে আমারই, সে আমারই হোক!!

স্বপ্নজাল

নাজমুল হক

নীরব নিস্তব্ধ নির্ঘুম রাত, সেলফোন হাতে
স্ক্রল করে কী-যেন খুঁজে বেড়াই মধ্য রাতে
এডিট করা প্রোফাইল ছবিতে ফেক হাসি
একাকিত্বের সম্মোহনে বিশ্বাস নিচ্ছে ফাঁসি ।

অচেনা বন্ধু বাড়ে, কমে যায় কাছের মানুষ
নকল জীবনে ডুবছি, উড়িয়ে মিথ্যে ফানুস,
ভালোবাসা প্রকাশটা এখন ইমোজিতে হয়
ভরসাহীন মুখের কথা,রস্ট্যাটাসে প্রমাণ রয় ।

সবই বুঝি, তবুও পরে থাকি আজব নেশায়
জীবনটা পরিণত হয়, জঞ্জাল বিভীষিকায়,
অবুঝ মানুষ সব হারিয়ে, নিরবে একা কাঁদে
সোশ্যাল মিডিয়া টানছে শুধু নেশার ফাঁদে ।

আবার ভাঙ্গে ঘুম
ইব্রাহিম খলিল

হয়নি উদয় বিবেক বোধের
জাগ্রত নয় চোখ,
এরাই না-কি সমাজ সেবক
প্রতিনিধি লোক।

রাস্তা ঘাটের শরীর জুড়ে
কুষ্ঠ রোগের ঘা,
প্রতিনিধি দিন কানাদের
চোখে পড়ে না।
এরাই আবার সেবক সাজে
মঞ্চে গিয়ে রোজ,
আমজনতার প্রয়োজনে
যায় না পাওয়া খোঁজ।

পাঁচটা বছর গর্তে লুকায়
ভোগ বিলাসের উম,
ভোটের বছর এলেই তাদের
আবার ভাঙে ঘুম।


গাঁয়ের ভাষা মায়ের ভাষা
জিহান রব্বানী জাকির

শরীয়তপুরের মানুষ আমরা,
ঢাকারে কই ঢাহা
টাকারে কই টাহা
রান্না করার চুলাটারে আমরা বলি পাহা।

গুড়কে আমরা মিডাই বলি
অভাবকে কই আহাল,
রান্না করার জায়গাটারে
আমরা বলি পাহাল।

ডিমকে আমরা আণ্ডা বলি
চিংড়ি মাছকে ইঁচা,
পেপেরে কই কমফা এবং
ঝাড়ুরে কই পিছা।

হলুদরে কই অলদি আমরা
কালোরে কই কাইল্লা,
চিরুনিকে কাহই কই আর
খালিরে কই খাইল্লা।

সিমকে আমরা উসসি বলি
চাউল ছাড়া ধান চিডা,
বাড়ির পাশের খালি জমি
তারে বলি বিডা।

পাট খড়ি-রে হরমাইল বলি
মুড়িরে কই উড়ুম,
নারকেল গাছ পরিষ্কার কে
আমরা বলি ঝুড়ুম।

সবাই যাকে প্লেট বলে
আমরা বলি থাল,
ঢাকনাটারে হরা বলেই
আসছি চিরো-কাল।

লাউ কে আমরা কদু বলি
পেয়ারাকে গইয়া,
সাত পুরুষের জনম গেছে
এসব কথা কইয়া

এটাই আমার গাঁয়ের ভাষা
মায়ের ভাষাও এটা,
এ-ভাষাতেই কথা বলি
সকল বেটি-বেটা।

এমন কথা শুনে কেহ
দিতে পারো হাসি,
তবু্ আমরা এমুন করেই
বলতে ভালোবাসি।

পবিত্র ইদুল আযহা
জান্নাতুল ফেরদৌস মুক্তা

ঈদের খুশি সবার ঘরে,
থাকে না কেউ দূরে সরে।
সবাই মিলে নামাজ পড়ে,
কোলাকুলি করে আনন্দ ভরে।

কোলাকুলি শেষে সবাই ফিরে,
আপন ঘরে আনন্দ ঘিরে।
নানান রকম সেমাই খেয়ে,
তারপরই শুরু কোরবানি নিয়ে।

ছুটে সবাই গরু নিতে,
ব্যস্ত সবাই কোরবানি দিতে।
মুমিন-মুয়াজ্জিন ব্যস্ত হয়ে,
লাগে কোরবানির আয়োজনে।

কোরবানি শেষে মাংস বিলায়,
গরিব-দুঃখীর মুখে হাসি ফোটায়।
নতুন জামা পরে সবাই,
উচ্ছ্বাসে ভরে চারদিক তাই।

গাড়ি নিয়ে কেউ বেড়িয়ে পড়ে,
কেউ বা হাঁটে পথের বাঁকে।
দেশ-বিদেশে ঈদ আনন্দ,
খুশির সুরে বাজে নতুন ছন্দ।

এলোমেলো হয় সব

হোসাইন মুহঃ দেলোয়ার    

 

বৃষ্টি পড়ে গাছের ডালে

বৃষ্টি পড়ে মাথায়, 

বৃষ্টিতে তাই কাজ হচ্ছে না 

আমার ছোট ছাতায়।

 

ঝড়ো হাওয়া বইছে এখন

কেমনে ঘরে থাকি,

পাখিরা সব যাচ্ছে কোথায় 

করে ডাকাডাকি?

 

ভাঙ্গা চোরা ঘরটা আমার 

কাঁপছে থর থর,

হঠাৎ করে ঝড় এসে যে

করছে নড়বড়।

 

আমি এখন থাকবো কোথায়

বৃষ্টিতে সব ভিজে,

পাখির মতো থাকার জায়গা 

পাইনা খুঁজে নিজে।

 

এমনি করে ঝড় বৃষ্টিতে

এলো মেলো হয় সব,

নেমে এলো সন্ধ্যা এবার

থেমে যায় কলরব।

 

নীলাভ প্রহর
মুনিয়া তালুকদার

আকাশতল আচ্ছন্ন তীব্র মেঘে,
অন্ধকারের ধোঁয়াশায় বিলীন নীলাভ আকাশ।
নীলাভতার অন্ধকারে, মেঘেরই ঘ্রাণ।

স্নিগ্ধ, নির্মল আকাশ
কেমন ভয়ংকর শূন্য!
ধোঁয়াশায় মোড়ানো নীল প্রহরের দৃশ্য,
একাকিত্বের মৃদু রঙ ছড়ায়।

দিগন্ত ছুঁয়েছে ওই সুদূর শূন্য প্রান্তে,
অন্ধকার জাগায় অবশ চিন্তার বেদনা,
হৃদয়ের দ্বারপ্রান্তে স্বপ্নময় নীরবতা।

স্নিগ্ধ, অথচ অধরা অস্তিত্বে ঘেরা

হারানো গন্তব্যে শুধুই ধোঁয়াশা,
কেন্দ্রবিন্দুতে
শুধুই বাবা! 

 

ঠিকানা

মোঃ আবদুল করিম বেপারী

 

আষাঢ়টা জোরালো না। শ্রাবণটা কেমন হবে জানি না। জোড়ামারা ঋতুর ভাব বলয় মিলতালে থাকে না। আকাশটা মেঘ মেঘ কিন্তু ভরা বর্ষা বাহন বাণী খুঁজে পাওয়া যায় না। রাস্তাঘাট ভেজা, রোদে যৎকিঞ্চিত শুকালেও পরিবহনের চাকার চাপে জমাট শক্ত হতে পারে না। খালের দু’কূল বেয়ে জোয়ারের পানি বিলের ভিতর ঢোকে না। বৃষ্টির ছড়াছিটা পানি যা ঝরে তা বিলের বাইরে যেতে পারে না। আমিষের স্বাদের স্বাধ মিটাতে বান দিয়ে মাছের চাষ হচ্ছে, চিন্তাটা মোটেই মন্দ না। বেকার নবিশ অলস অর্থের খবিশ যা ভাবে তা সাধারণত কেউ বদল করতে পারে না। বিল যেন বিল নয়, এ যেন গুচ্ছ গাঁথা পুকুরের ছড়া। মাছের মালিক কুড়ায় ঝিনুক খুঁজে মুক্তার খনি। সামনের দিকে সবাই তাকায় পিছনের দিকে নয়। আজকের ভাবনা আজই ভাব, ভবিষ্যতের ভাবনা ভালো নয়। কিন্তু ভাজন আজকের দিন কালকে গড়ালে, কে গুনবে পরশু দিনের গণনা। একবাক্যে সমস্বরে বলবেন সবে খনার ক্ষণগণনা আমার কাজ না। তবে সাহেব মাথার মনিরত্ন হৃদয়ের ধন-সম্পদের মালিক কারা ?

সন্তান-সন্ততি, প্রজন্ম-প্রজাতি বংশধর-বংশাবলী রক্তের ধারা ধরে ক্রমে এগুবার তরী মা, লক্ষ্মী, সরোমতি না দেবতার দান, ভাগ্যের বিধান নিয়তির নিয়ন্ত্রণ জ্ঞান জ্যোতি।


ঈদের ছুটি। বাড়ি বাড়ি চাকুরীজীবি পরবাসী ঘর বাহির সবাইকে সুস্বাগতম। চাঁদের আলো চন্দনের ছোয়া, আনন্দ ঘন ঘন। দু’চার দিনের তরে হলেও সুধা যেন সুরেশ্বরের সেই গান, ‘কিসের ছাতার বাড়ি ঘর মন চলেছে সুরেশ্বর’ টইটম্বুর দহলিজ, উনুনে হাড়ি সদা তপ্ততার আবাস। আয় যায় খায় দায় কোন খানে নাই কোনো বাঁধা। আষাঢ়ের ধারা শ্রাবণের সারা, দক্ষিণা বাতাস টানা টানা বয়। মানেনা মানা উজানের লোক ভাটিতে যায়, ভাটির লোক উজান। খুঁজে কি দেখছ ঝড়-ঝাপট, মেঘ-বাদল, বান-তুফান, কষ্ট-ক্লেশে ছুটা ছুটি এটা কিসের টান। ভেবে দেখ না
পঙ্খী তোরণ এটা কিসের টান। ভেবে দেখ বিচরণ বাজিরা এটা সেই মহময়ী গ্রোথকারী মা-বাবার হৃদয় মহান।


বাবা-ছেলে-নাতী মিলে গরুর হাটে যান। এক হাটে না পেলে ছুটে অন্য হাটে। পথে পথে দামাদামি, কখনও কেনা হয়। বৃষ্টি বেজায় বে-রসিক, কাঁদা গোবরে একাকার সেকি দোহান ব্যবস্থা। তারা তিনজন তিন পুরুষ সাঁজি গরুর লেজের তাড়নায় কাপড়চোপর দেহের কর্মসারা। আসলে কিসের সন্ধি আছে কি কারো জানা? একটা গরু দেখে দশ জনে, কিনে একজন সাত, পাঁচ, তিন আবার একা একজন। মাশাল্লাহ। সাবধানে যাবেন, এক গরুর পেছনে পাঁচ সাতজন ক্রেতা। তার সাথে পশু প্রতি রাখাল নিধেন দু’জনা, দালালে দালালে হাট থাকে ভরা। পকেট মার, জ্বাল টাকা বিতরণকারী নেহাত কম না। ডাক ডাকিয়াদের মানের উপর নির্ভর করে হাসিল। গরীবরা বেজার থাকে ধনীরা হাসে খিল খিল। ঈদ মানেই তো আনন্দ। খুশি। মিলনের সাথ মিলনের সন্ধি। খুশিরা বাজারে বাজারে, বে-খোশরা নিরানন্দে নৌকা বাইচ খেলায়, মা-বাবার পাশে কেঁদে কেঁদে ক্লান্ত, চাহিদা লাল টুক টুকে সার্ট আর দু’টুকরা মাংস দিয়ে একবেলা পেট পুরে চারটে ভাত।


শুধু তারাই জানেন কষ্টের ললিত আবরণ, না ফেলা যায় না। থাকে বহালের শত উপায়। তবু আমরা সবাই সামিল কোরবানির মহিমায়। বিলাস তো এমন আছে রান পাঠাও মেয়ের বাড়ি, ঠেংটা বোনের বাড়ি। দশ বিশ কেজি আগে কেটে দাও রান্না করি। তারপর কেটেকুটে গরীবেরা আসার আগেই ঘোষণা মাংস নাই। আসল আনন্দ যাদের পাবার কথা তারা আনন্দ পেল না। ধনীর অগোচরে, মনের মধ্য মনিতে বেদনার চিন চিন ঘা নিয়ে ফিরে গেল সেই সুধামনে যেখানে আছেন স্বযং রাব্বানা। পদহারী, পদধারী, পদের মালিক যারা পাঁচ, সাত, দশটা কোরবানি দেয় তারা। সময়ের অনেক পরে গো-ব্যবসায়ী এসে বলে, ‘ভাই আমার গরুর দামটা।’ দেব। এক সময় এসে নিয়ে যাস। মনের ক্ষোভে অস্ফুট স্বরে বকিতে বকিতে কখনও চোখের পানি ফেলে দরবারীর দরবারে নালিশ করিতে করিতে বিচার দিয়া কয়, ‘হে আল্লাহ তুমি সব দেখ, তোমার কাছে আমার নালিশ থাকল, বিচারের মালিক তুমি আল্লাহ।’

 

সত্য মিথ্যা সব দেখেন আল্লাহ। কার দোওয়া আর কার কোরবানি কবুল হবে জানেন আল্লাহ। উপার্জনের টাকা হালাল না হারাম জানেন আল্লাহ। পূণ্য না পাপ দিবেন জানেন আল্লাহ। তারপর, মানুষ তুমি কেন আল্লাহর নামে মানুষ ঠকাও? ইব্রাহিম (আঃ), ইয়াকুব (আঃ), ইসমাইল (আঃ) তারপর আমরা নবী মোহাম্মদ (স) উম্মত। কেয়ামত পর্যন্ত বাহিত থাকবে এ-ধারা। হে আদম (আঃ) সন্তানগণ, অন্যায় করিও না। মানুষ হয়ে মানুষকে ঠকিও না। জীবন মৃত্যুর তিলক্ষণে দাড়িয়েও সত্য পরিহার করিও না। মনে রেখ, মিথ্যা কখনও সত্য হয় না। সত্য কখনও মিথ্যার নিচে চাপা দেয়া যায় না। অর্থ, সম্পদ, ক্ষমতা ও নারীর প্রতি লোভে লোভায়িত অর্জিত সকল অর্জন ডুবে যেতে সময় লাগে না। জীবন তো একটাই, যৌবন একবারই, বৃদ্ধের দাড়দাড়ী, টল-মল গতি বিধি, মরণের আগে বেঁছে নাও তোমার ঠিকানা।


ঈদুল ফিতরের স্মৃতি

মোঃ মজিবর রহমান

 

গত শতাব্দীর ষাটের দশকের আমার শৈশবকালের ঈদুল ফিতরের স্মৃতি আজো মনে পড়ে। বয়সে ছোট থাকায় আমার জন্য রোজা থাকা জরুরী ছিল না। তবু আগ্রহভরে দু’চারটা রোজা রাখতাম। আমার ধর্মপ্রাণ বাবা ও মা তাতে উৎসাহই প্রদান করতেন। ঈদের সময় নতুন জামা জুতা ও টুপী কেনা হতো। ছেলেরা লুঙ্গি বা তহবন এবং জামা, পিরহান বা পিরান পরিধান করত। কেউ কেউ পাজামা পাঞ্জাবী পরিধান করতেন। সামান্য কিছু লোক সুট ও কোট পরিধান করতেন।

 

ঈদের সময়কে ঘিরে হাটবাজার জমজমাট থাকত। মেয়েদের আলতা, চুড়ি, খেলনা, ছেলেদের বাশি, বেলুনও অন্যান্য খেলনা বিক্রি হতো। কাপড় পছন্দ না-হলে আনন্দ কান্নায় রূপ নিত। এখনকার মতো হাটবাজারের সংখ্যা এতো বেশি ছিল না। ঈদের চাঁদ দেখার জন্য সবাই উদগ্রীব ছিলাম। ঈদের চাঁদ দেখতে বড়দের সাথে আমরাও জড়ো হতাম খোলামাঠে। ঈদের চাঁদ দেখতে পেয়ে নিজেকে গৌরবান্বিত মনে হতো।

 

সে সময় রোজা ছিল শীতকালে। কনকনে শীতের মধ্যে উঠে সেহেরী খেতে হতো। তবে দিন ছিল ছোট। খ্রীষ্টীয় মাস আর আরবী মাসের সময়ের পার্থক্যের কারণে রোজার সময়কালের এ পরিবর্তন। বর্তমানের মতো সে সময়ও ঈদ সমান আনন্দ নিয়ে আসতে পারেনি। গ্রামের আর্থিক অবস্হা বর্তমানের তুলনায় আরো খারাপ ছিল। অনেক শিশু শ্রমিক বা দিনমজুরকে ঈদের দিনেও কাজ করতে হতো। অপেক্ষাকৃত সম্পদশালীরা রোজার ঈদের সময় জাকাত ও ফেতরা প্রদান করতেন যা গরীবদের আনন্দের বারতা নিয়ে আসত। কবি নজরুলের ভাষায়-

‘জীবনে যাদের হররোজ রোজা ক্ষুধায় আসে না নিদ,

মুমূর্ষু সেই কৃষকের ঘরে ফিরে এলো আজ ঈদ।’

 

এখনতো গ্রামেও মসজিদে মসজিদে ঈদের জামাত অনুষ্ঠিত হচ্ছে। সে সময় ঈদের জামাত মাদ্রাসা, স্কুল মাঠ বা অন্যান্য খোলা মাঠেই ঈদের জামাত অনুষ্ঠিত হতো। হাজারো লোকজন এ জামাতে শরীক হতেন। এ প্রসঙ্গে ডামুড্যা হামিদিয়া কামিল মাদ্রাসা জামাতের কথা উল্লেখ করতে হয়। সে সময়ে ডামুড্যা হামিদিয়া কামিল মাদ্রাসা প্রাঙ্গনে বিশাল ঈদের জামাত অনুষ্ঠিত হতো। ডামুড্যা পৌরসভা, দারুল আমান, পূর্ব ডামুড্যা, সিড্যা, কনেশ্বর ও শিধলকুড়ার লোকজন এ ঈদের মাঠে সামিল হতেন। বাবা আমাদের সব ভাইকে নিয়ে আমাদের গ্রামের বাড়ি কাইলারা হতে এ ঈদের মাঠে হাজির হতেন। স্মরণে আসে ডামুড্যা কামিল মাদ্রাসার সুপারিনটেনডেন্ট মরহুম মাওলানা আবদুল হক সাহেবের সুললিত কন্ঠের ঈদের ওয়াজ। ওয়াজ শেষে ঈদের নামাজ। কয়েকজন মোদাররেস সার্বিক ব্যবস্থাপনায় থাকতেন। উচ্চকন্ঠের অধিকারী ব্যক্তিগন মোকাববের হতেন যাতে মুসল্লীদের নামাজে বিঘ্ন নাঘটে। নামাজ শেষে কোলাকুলির মাধ্যমে শেষ হয়ে যেতো ঈদের নামাজ। নামাজ শেষে বন্ধুদের বাসায় গিয়ে খেজুর রসের নাস্তা বা পায়েস, সেমাই, হাতে বানানো সেমাই, সাগুর নাস্তা ও খিচুড়ি খেতাম। বন্ধুরা আমাদের বাড়ীতেও আসত।

 

ঈদ উপলক্ষে মুরব্বীরা সালামি দিতেন। সালামি কিছু অংশ ভিক্ষুকদের এবং বাকি টাকা দিয়ে বন্ধুবান্ধবদের নিয়ে বুট, চিনাবাদাম, আইসক্রিম কিনে খেতাম। এ উপলক্ষে অনেকের বেশ আয় হতো। ঈদ উপলক্ষে কোথাও হাডুডু ও ফুটবল খেলার আয়োজন হতো যেখানে আমি শুধুই দর্শক। বিভিন্ন আনন্দ উৎসবের মাধ্যমে ঈদের ছোট দিনটি কিভাবে পার হয়ে যেতো টেরও পেতাম না। আবার কি ফিরে আসবে সেই সুখের দিন?

إرسال تعليق (0)
أحدث أقدم