বাবা দিবস বিশেষ (গল্প-কবিতা) সংখ্যা ২০২৫
সেলিম
মন্ডলের এক গুচ্ছ কবিতা
।। এক বছরে।।
১
এই এক বছরে যতবার আব্বাকে স্বপ্নে দেখেছি
দেখেছি— তার বয়স কমে গেছে
ক্যাথেটার নেই
নীচের দিকে ঝুঁকে পড়া নেই
শুধু হাসিমুখে কাঠবিড়ালির মতো ঘোরাঘুরি করছে
২
এক বছর যে খুব দীর্ঘ নয় তা বুঝেছি
তবুও এক বছরের লড়াই কীভাবে চামড়া কুঁচকে দেয়
চুলে পাক ধরে তা বোঝা গেল
আর বোঝা গেল—
একটা গাছ যতই নুইয়ে পড়ুক তার ছায়াটুকুই আমাদের জীবনসংশ্লেষ
৩
আমাদের বাগানের গাছগুলো আমাকে বাবা করে তুলল
ওষুধ দেওয়া, জল দেওয়া, নিড়ানো...
তবুও এই একবছরে গাছের পাতায় হাত রাখলে বোঝা যায়
মাটির সঙ্গে নিবিষ্ট হতে গেলে
নিজেকে সবার আগে গাছ করে তুলতে হবে
৪
আমি বাবা হতে পারিনি
বাবা, সংসারের সেই ছায়া যার নীচে সবাই বসে জিরিয়ে নেবে
পাখি
পোকা
মানুষ
সবাই
৫
বাবা হতে হবে
সন্তানের অপেক্ষায়। পিতৃশোক চিনচিন করে
দূরের আকাশে কোথায় সেই ধ্রুবতারা... যাকে দেখি সেই
মেঘ
সেই কি সন্তান?
৬
এক বছর
৩৬৫ দিন
আব্বা
আব্বা
আব্বা
বা বা র মু খ
খান মেহেদী মিজান
বাবার মুখটি হৃদয় আকাশে
শুকতারা হয়ে রয়,
বাবা আমার সারাক্ষণ ভাবনায়
বিশেষ দিবসে নয়।
যার ঔরসে পৃথিবীতে আসা
বড় হই যার স্নেহ ছায়,
তাঁকে মনে পড়া কিবা ভালোবাসা
দিবসের মাঝে রাখা যায়?
আমার বাবা কম পড়া মানুষ
ফল ফসলে বেড়ে ওঠা,
জমি জোঁত যার ছিল সম্বল
টিনের চালার ঘর কোঠা।
তাঁর ছিল বড় শক্তি সততার
হাসিমাখা মুখ খান,
ভালোবাসা পেলে গল্প প্রেমে
কেটে যেতো দিনক্ষণ।
খুব মনে পড়ে বাবা তোমার সেবায়
ছেড়েছি শহরের পড়া,
তোমার দোয়ায় ভালো কাটে জীবন
তোমার আদর্শে যা গড়া।
তোমার হাতের লাগানো গাছপালার
ফল ফসল ভোগে সবে,
আমরা মানুষ হয়ে ভুলে যাই যদিও
পশু পাখির মনে রবে।
যেখানেই আছ ভালো রাখে যেন ওই
করুনাময় মহান রব,
তুমি ভালো থাকলে মনে স্মৃতি আঁকলে
আমার পাওয়া হয় সব।
বা বা
র কেনা তা ল মি ছ রি
মো: রফিকুল ইসলাম
মাস পেরুলে মাইনের টাকায় কেনা
কাগজের পুটলিতে পুরে
তাল মিছরি নামক
একটুকরো ভালোবাসা নিয়ে
বাড়ি আসা স্কুল শিক্ষক বাবা
আজ আর নেই।
নেই ভাই–বোনদের সেই
ধুন্দুমার কাণ্ডও!
কার আগে কে ভাগ বসাবে
ভাবতেই চোখ ঝাপসা হয়ে আসে।
লজ্জাও হয় খানিকটা,
কি বোকামিই না করেছি তখন!
মাসান্তে এক দুই দিনের বেশি
কাছে পাইনি বাবাকে কখনও।
কিন্তু সন্তানের মুখে হাসি ফোটানোর
প্রাণান্ত চেষ্টা দেখেছি আমৃত্যু।
সর্বদা পরোপকারী বাবা
তার শেষ বয়সে
ঘরের দাওয়ায় বসে
যাকেই দেখেছেন তাকেই ডেকে কাছে বসিয়েছেন।
কিছু একটা দেয়ার জন্য
ছেলে মানুষের মতো
বায়না ধরেছেন মায়ের কাছে।
যদিও কাউকে দেয়ার মত
ঘরে তেমন ছিল না কিছুই!
লজ্জাবনত মা আড়ালে চোখ মুছেছেন বহুবার।
অথচ করার ছিলো না কিছুই।
আজ আমিও বাবা হয়েছি,
সন্তানের জন্য এটা ওটা
আমিও নিয়ে যাই হামেশাই ।
কিন্তু আমার বাবার
পাঁচ সিকিতে কেনা
সেই তাল মিছরির ভালোবাসা
আজও ভুলতে পারিনি।
পারবো না কোন দিন।
বা বা
রফিক ওসমান
(উৎসর্গঃ ওসমান পেয়াদা)
বাবার কথা বারে বারে
খুব যে মনে পড়ে
বাবার অভাব তাড়া করে
যখন ফিরি ঘরে।
ঘরে ফিরে পাই সকলি
পাইনা বাবার মুখ
কেউ দেখে না তখন আমার
কষ্টে ভরা বুক।
বাবা ছিলেন ন্যায় বিচারক
শুনছি মায়ের কাছে
দলিল পর্চা হিস্যাতেও
সাক্ষ্য আজও আছে।
বাবা যেনো থাকে সুখে
ওই-না মাটির ঘরে
প্রভু তুমি দিও জান্নাত
দয়া মায়া করে।
নী ল ক ষ্ট
ফিরোজ ভুইয়া
বাবার মৃত্যু আমাকে
কাঁদায় অর্হনিশি।
হৃদয়ের আকুতি কেউ দেখে না
দেখে না তো প্রতিবেশী।
কষ্টে বদন নীল হয়,
যখন আমার বাবার
কথা মনে পড়ে।
কষ্টে চৌচির হয় বুক
যখন যাই বাবার
কবরের ধারে।
বাবার লাশ দেখা
ভাগ্যে জোটেনি।
তার নতুন কবর দেখেছি।
কবরের মাটি চাপড়ে,
হাউ মাউ করে কেঁদেছি।
তখন আমি কলেজে পড়ছি।
মনষার নীল ছোবল,
আমাকে কুঁড়ে কুঁড়ে খেয়েছে।
চব্বিশ বছর পর আমাকে,
দ্বিতীয় ছোবল মেরেছে।
আমার মায়ের মৃত্যুর মধ্য দিয়ে।
মায়ের মৃত্যু আমি কাছ থেকে, দেখেছি।
আমি কষ্ট পেয়ছি।
কষ্টগুলো নীল হয়ে চিত্তকে,
ঠোঁকড়াতে থাকে।
বড় কষ্টে আছি!!
পৃথিবীর রূপ রস্ বর্ণ গন্ধ,
যখন গণ্ডুষ ভরে
পান করতে
উদ্যত হই।
তখনই কষ্ট গুলো নীল হয়ে আসে।
আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে ফেলে আমাকে।
বুঝতে পারি পুষ্প সুধা
আমার জন্য নয়।
প ড় স না কে ন
সুলতান মাহমুদ
কিরে পড়স না কেন? বলেই ধুমধাম কিল! মিলুর পিঠে পাকা তাল পড়ল।
ব্যথায় বেচারা কোৎ কোৎ শব্দ করছে। দেখ চিউক্কুর দিবি না। চিক্কুর দিলে আবার মাইর
খাবি। মিলু চিক্কুর (কান্না) দিতে গিয়ে থেমে যায়। সে নীরবে পড়তে থাকে। কিন্তু পড়া
মাথায় ঢুকে না। চোখে লেগে থাকে শুধু। চোখের পলক ফেল্লেই পড়া ভেগে যায়। পাশ
থেকে আবার চিৎকার। মনে মনে কী পরস? তুই কি বিয়ে পাশ দিছস যে আস্তে আস্তে পড়স। পড়বি
জোরে জোরে। তোর পড়ার ঠ্যালায় যাতে আশেপাশে দুই চাইর গ্রামের লোক ঘুমাইতে না পারে।
জোরে পড়। মিলু এবার জোরে জোরে পড়ে। এত জোরে পড়ে যে কলিজা ছিড়ে মুখে বের হয়ে আসতে
চায়। পড়া নিয়ে মিলু প্রায়ই এ ধরণের শাসনের শিকার হয়। শাসনটা বাবাই বেশি করেন। তার
ধারণা উঠতে বসতে পোলাপানদের ধমকের উপর রাখতে হবে। ধমক আর চমক এ দুইয়ে মিলে বাড়বে
লেখাপড়ার ঠমক। বাবা অবশ্য শিক্ষিত মানুষ। আইয়ে পাশ। ছোটবেলায় নাকি কসে
লেখাপড়া করেছেন। প্রাইমারি পর্যন্ত অংক ভালো পারেন। আর ইংরেজি গ্রামারও
টুকটাক খারাপ পড়ান না। আরে ব্যাডা তগো মতন এত সুযোগ সুবিধা আমরা পাই নাই। লুঙ্গি
পইরা স্কুলে গেছি। পায়ে স্যান্ডেলও আছিল না। দিনে গরুর ঘাস কাটছি আর রাইতে পড়ছি।
পড়তে পড়তে যখন ঝিমুনি আসত তখন চোউক্কে সরিষা তেল দিতাম। আবার পড়াতাম। আর তোরা অহন
কী পড়স? জোরে পড়। মিলু ঘাড় কাত করে পড়তে থাকে কিন্তু তার মাথায় পড়া ঢুকে না। সে
কেবল ভাবতে থাকে কখন আবার তার বাবা তাকে ধমক দিবে। আসন্ন ধমকের ভয় মিলুর পড়ার
প্রতি মনোযোগ নষ্ট করে দেয়।
পড়াটাকে মিলু সবসময়ই একটা ভীতিকর বস্তু হিসেবে দেখে
এসেছে। পড়া যে একটা আনন্দদায়ক বিষয় হতে পারে তা মিলুর কখনোই মনে হয়নি। বাড়িতে
ধমক, মক্তবে বেতের বাড়ি, স্কুলে লাঠির বাড়ি এর বেশি কিছু সে পড়াশোনার মধ্যে ভাবতে
পারে না। তাকে যেন একটা অজানা ভয় তাড়িয়ে বেরায়। সবদিকে সাপের ফণার মত ফোঁস ফোঁস
শব্দ। সেখানে কোন সহানুভূতি নেই, উৎসাহ নেই। শুধু পড়। পড়া না পারলে আছে
শারীরিক ও মানসিক আঘাত। পড়া বিষয়টাকে তাই কেউটে সাপের বিষের মতো মনে হয়
মিলুর কাছে।
মিলুর পড়ার পরিবেশটাও তার ঠিক পছন্দ না। তার চার ভাইবোনের একটাই
পড়ার টেবিল। টেবিলের চার পাশে যে যার মত পড়ছে। একজনের পড়া আরেকজনের কানে ঢুকছে। মাঝখান
থেকে মিলু কি পড়ছে সেটাই সে গুলিয়ে ফেলছে। মিলুর মাঝে মাঝে মনে হয় তার যদি একটা
আলাদা পড়ার ঘর থাকত। সেখানে একটা আলাদা টেবিল থাকত। তার বইগুলো পরিপাটি করে সাজানো
থাকত। টেবিলের পাশে একটা জানালা থাকত। জানালার ওপাশে একটা ছোট্ট ফুলের বাগান।
হাসনা হেনা, গোলাপ, বেলী, জুঁই, চামেলী ফুটত সেখানে। নিশুত রাতে ফুরফুরে বাতাস
বইত। সে বাতাসের সাথে আসত ফুলের ঘ্রাণ। সে নীববে তার পড়া সাজাত। কেউ তাকে
বিরক্ত করত না। পড়ায় উৎসাহের নামে উদ্ভট সমালোচনা করত না। কিন্তু তা হওয়ার নয়।
কারণ মিলুদের সে আর্থিক ক্ষমতা নেই যে তাদের সবার জন্য আলাদা পড়ার টেবিল থাকবে।
থাকবে পড়ার মতো একান্ত একটা পরিবেশ।
মিলুর বাবা চায় সে আরবিটা শিখুক। মুসলমানের ছেলে আরবি জানা
ফরজ। মিলু গ্রামের মক্তবে আরবি শিখতে যায়। কিন্তু মক্তবের সমস্যা অনেক।
প্রথমত, অনেক ছাত্র কিন্তু সে অনুপাতে শিক্ষক মোটে একজন। কমপক্ষে সত্তর আশি জন
ছাত্র ছাত্রী একটা ঘরে কিচিরমিচির শব্দ করে পড়তে থাকে। মজার ব্যাপার হচ্ছে একই
কক্ষে আলাদা আলাদা স্তরের ছাত্র। কেউ হয়ত আলিফ, বা, তা, ছা পড়ছে। কেউ আলিফ-পেশ-উ,
বা-পেশ-বু। কেউ বা আনাকুম, উনাকুম, ইনাকুম। কেউ সূরা পড়ছে। কেউ কোরআন পড়ছে। এতে
করে হজুরের পক্ষে পড়ার ধারাবাহিকতা রক্ষা করা সম্ভব হয় না। কোন একজন বিশেষ ছাত্রের
প্রতি পূর্ণ মনোযোগ দেওয়া সম্ভব হয় না। হজুর সকালে একবার পড়া দেন এবং শেষ মুহূর্তে
সে পড়া আদায় করেন। পড়া দেওয়া নেওেয়ার এ সময়টাকে বলা হয় ছবক। মক্তবে যারা শিক্ষক
তাদের অধিকাংশেরই আরবি উচ্চারণ জ্ঞান কম আর আরবি ব্যকরণ সম্পর্কেতো ধারণা নেই
বল্লেই চলে। তাজবিদ সংক্রান্ত নিয়ম কানুনের বিষয়ে এরা সম্যক অবগত নন। ফলে
শিক্ষার্থীরা ভুল-ভাল আরবি শিখে থাকে। যেমন- র যবর র কে হজুর পড়াচ্ছেন রা যবর
রা। কিংবা খ জবর খ কে পড়াচ্ছেন খা জবর খা। মিলুর সমস্যা অবশ্য অন্য জায়গায়। এত
মানুষের মাঝে সে আরবিটা ঠিক বুঝে উঠতে পারছে না। আরবি অক্ষরটাই সে বুঝতে পারছে না।
আর এ না বুঝার ব্যাপারটা হুজুরও ধরতে পারছে না। তিনি শুধু জানেন, সকালে একবার পড়া
দিতে হবে। দ্বিতীয় বার পড়া না পারলে বেত দিয়ে ঠপাস ঠপাস পিটুনি দিতে হবে। আর
মিলুতো লাঠি দেখলে এমনিতেই পড়া ভুলে যায়। যেটা তার অতি পুরানো রোগ। মক্তবে কিছু
দুষ্ট পোলাপান আছে যারা আবার পড়ার চেয়ে দুষ্টামি করতেই বেশি মজা পায়। একবার
এক ছেলে পিছন থেকে এসে মিলুর চোখে মিল্লাত বাম (মাথা ব্যথার মলম) লাগিয়ে দিয়েছে। মিলুতো
চোখের যন্ত্রণায় অস্থির। টানা সাত তার চোখের চারপাশ ফুলে টিউমার আকৃতি ধারণ
করেছিল। আরেকদিন এক ছেলের সাথে কি নিয়ে যেন হলো তর্কাতর্কি। অতঃপর
মারামারি। সর্বশেষ হুজুরের শপাং শপাং বেতের বাড়ি। সবমিলিয়ে মক্তবে সে আরবিটা
ঠিক শিখতে পারছিল না। এর মাঝে একদিন হুজুর তাকে ওমালাইকাতিহি বানান করতে দিছে
কিন্তু সে সেটা বানান করতে পারেনি। সে অপরাধে তাকে বেদম পিটুনি দেয়া হলো। পিটুনি
খেয়ে মিলুর আর মক্তবে যাওয়া হয়নি।
মিলুর পড়াশোনার ক্ষেত্রে আরেকটা সমস্যা হলো স্কুল থেকে বাড়ির
দূরত্ব। স্কুলে আসা যাওয়ার পথে অনেকটা সময় চলে যায়। তার সাথে যোগ হতো
ক্লান্তি। স্কুল থেকে বাড়ির দূরত্ব বেশি হওয়ায় শিক্ষকদের সাথে ক্লাসের পর
যোগাযোগ করা সম্ভবপর হয় না। তাই পড়াশোনায় পিছিয়ে যেতে হয়। বর্ষাকালে সমস্যা আরও
প্রকট হয়ে দাঁড়ায়। একহাটু কাদা পায়ে প্রায় আধামাইল হেঁটে মূল সড়কে উঠতে হয়। মিলুর
কাছে মনে হয়েছে ভালো ছাত্র হতে হলে ব্যতিক্রম বাদে স্কুলের কাছাকাছি বাড়ি হলে
ভালো। দেখা গেল মিলুর প্রতিদিন দু তিন ঘন্টা রাস্তায় আসা যাওয়ার পথেই কেটে
যাচ্ছে। ঠিক সে সময়টা হয়ত তার বন্ধু বাড়িতে পড়াশোনার পিছনে ব্যয় করছে।
মিলুর বাবা শিক্ষিত মানুষ। দু চার গ্রামের মানুষ তাকে মান্যগণ্য
মনে করে। ফলে মিলুদের বাসায় বিচারপ্রার্থীদের ভীড় লেগেই থাকে। সকাল বেলা মিলুর
পড়তে ভালো লাগে। সারাদিনের ক্লান্তি রাতের ঘুমের পর শেষ হয়ে যায়। শরীরটা
ঝরঝরে লাগে। এসময় অল্প পড়লেও অনেক কাজ হয়। কিন্তু প্রায় সকালেই দেখা যায় কেউ না
কেউ ঘরে এসে বসে আছে। তারা বাবার কাছে বিভিন্ন অভিযোগ নিয়ে আসে। মিলুর পড়ার আলাদা
কোন ঘর নেই যে সে অন্য কোথাও গিয়ে পড়বে। তয় হুনেন মিয়া বাই, ‘খলিলে আমার আইলে গরু
বাইন্ধা আমার ক্ষেতের অর্ধেক কলুই খাওয়ায় হালাইছে। এর একটা বিহিত আপনের করতে হইব।’
কুদ্দুস বয়াতির কেইস ভিন্ন। সে বাবাকে বলে মামু পোলাইত কাম একখান ঘডায় লাইছে। কি
ঘডাইছে মামু? আর কইয়েন জব্বর মেম্বরের মাইয়া বাইর কইরা লইয়াছে। মাইয়া আমার পোলারে
বিয়া করব। বিয়া না দিলে বিষ খাইব। ঐ-দিকে জব্বর মেম্বার আমার পোলার নামে অপহরণ
মামলা করছে। কি বিপদে পড়লাম কন দি? বাবা মাথা নাড়ে। মিলু তখন পড়া বাদ দিয়ে কথা
গিলতে থাকে। হঠাৎ মিলুর উপর বাবার চোখ পড়ে যায়। সে বাঘের মত গর্জে উঠে। কি রে পড়স
না কেন?
মিলুর বাবা খুব ভোরে ঘুম থেকে ওঠেন। তিনি চান তার ছেলে মেয়েরাও
সকালে উঠবে। মিলুকে তাই নিয়ম করে খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠতে হয়। ঘুম জড়ানো চোখে সে
বাবার সাথে প্রাতঃভ্রমণে বের হয়। মিলুর বাবা এই সময়টা ব্যয় করে মিলুকে ট্রান্সলেশন
শেখানোর কাজে। আমি যাই এইডার ট্রান্সলেশনডা ক। মিলু ভয়ে ভয়ে বলে—‘আই
গো।’ তুমি যাও—‘ইউ গো।’ সে যায়? মিলু এবার মাথা চুলকায়। এইডা কোন পার্সন। মিলুর
ভিতরটা গুলিয়ে আসে। সে বিড়বিড় করে ঠোঁট নাড়ায়। না পারলে না করবি। ভং ধরার দরকার
কি! এইডা থার্ড পার্সন সিংগুলার নাম্বার। থার্ড পার্সনে মূল ভার্ব এর সাথে কি যোগ
করতে হয়? মিলু ভয়ে ভয়ে বলে- এস। তাইলে এইডা কি হইব? হি গৌজ। হুম। মনে থাকে যেন।
দরকার হয় তুই তোর বাপের নাম ভুইলা যাবি কিন্তু থার্ড পার্সনের লগে যে এস বা ইএস যোগ
হয় এইডা ভুলবি না। আরেকটা ট্রান্সলেশন ক—আমার একটা গরু আছে।
মিলু চটপট জবাব দেয়—আই এম এ কাউ। বাবা এবার মিলুকে হুট করে একটা গাট্টা দেয়। হ তুইতো
গরু। গরু কোথাকার! মিলু বুঝতে পারে না ভুলটা কোথায় হলো। গাট্টা খেয়ে এই সাত-সকালে
সে পুরাই খাট্টা হয়ে গেছে।
মিলুর বোন শিল্পী অবশ্য ভালো ছাত্রী। সে ইংরেজি গ্রামার খুব
ভালো বুঝে। টেন্সের সব নিয়ম কানুন সে ভালোভাবে রপ্ত করেছে। বিষয়টি একদিকে
মিলুর ভালো লাগে কিন্তু এটা তার জন্য আরেকদিকে হয়েছে খারাপ। বাবা যখন ভাই-বোনদের
পড়াতে বসেন তখন শিল্পীকে কোন কিছু জিজ্ঞেস করলে গড়গড় করে উত্তর দিয়ে দেয়। ওদিকে
মিলু প্রায়ই ভুল করে। তখন বাবা বলে—তোরা ওর পা ধুইয়া পানি
খাইতে পারস না! মিলু তখন ঘিলু পুরাই লুজ মোশনে চলে যায়।
মিলুদের সময়ে বিটিভিতে খুব ভালো ভালো অনুষ্ঠান হতো। আলিফ লায়লা,
ম্যাকগাইভার, হারকিউলিস, রবিনহুড ছিল অন্যতম। শুক্রবার দুপুরে সিনেমা ছিলো সবচেয়ে
আকর্ষণীয়। মিলুর বাবা আবার টিভির কোন অনুষ্ঠান মিস করত না। তাই পড়ার চাপ থাকলেও
এসব অনুষ্ঠান উপভোগ করার ব্যাপারে তেমন বিধিনিষেধ ছিলো না। ঠিক ঐ সময়ে গ্রামে
ভিসিআরের প্রচলন ঘটে। ভিসিয়ার ভাড়া করে এনে গ্রামের যুবকরা সারারাত নানা ধরনের আজে
বাজে সিনেমা দেখত। বিষয়টি বাবা খুব একটা পছন্দ করত না। একদিন মিলুদের কয়েক
বাড়ির পর এক বাড়িতে রাতে ভিসিয়ার আনা হলো। সেদিন টিভিতে রবিনহুড দেখাচ্ছিল। মিলুর
চাচাতো ভাই মিলুকে চুপে চুপে ভিসিয়ার দেখার আহ্বান জানালো। মিলু চুপিসারে চাচাতো
ভাইয়ের সাথে রাতে ভিসিয়ার দেখতে চলে গেলো। সেতো অবাক! উঠান লোকে
লোকারণ্য। তিল ধারণের ঠাঁই নেই। ভিসিআরের লোভে ছেলে বুড়ো সব জড়ো হয়েছে। মিলু
তার চাচাতো ভাইয়ের সাথে একপাশে বসে পড়ল। সে অদ্ভুত দৃষ্টিতে ভিসিআরের দিকে তাকিয়ে
আছে। জীবনে প্রথম ভিসিয়ার দেখার সুযোগ। এক অদ্ভুত অনুভূতি। দশ মিনিটের মাথায় বাবার
আগমন। সে হুংকার দিয়ে জিজ্ঞেস করল এই খানে মিলু আইছস নাকি? মিলুর তো বাবাকে দেখে
আত্মা খাঁচাছাড়া হওয়ার যোগাড়! ওদিকে মিলুর চাচাতো ভাই বাবার সামনে পড়ে গেছে। তার
উপর চলছে বেদম চড় থাপ্পড়। মিলু কোনরকম পরিমরি করে দিলো ছুট...। এরপর মিলুর জীবনে
কি ঘটেছিলো তা পাঠক আপনারই চিন্তা করুন। সব কথাতো আর খুলে বলা যায় না!
তু ই ছা ড়া
নাজমুল হক
তুই ছাড়া নেমে আসে নিরবতা শহরে
এলে তুই পিপিলীকা দল বাঁধে বহরে
তোর নামে থেমে যায় প্রকৃতির ক্রন্দন
হাসির মুগ্ধতায় চলে বুকের স্পন্দন !!
তুই ছাড়া মেঘ ভাসে রোদ্দুর আকাশে
তোকে দেখে ভয়ে পাখি দমকা বাতাসে
তোর নামে বোকা চিলটাও উড়ে যায়
দানবীয় সুর্যটা চাঁদটাকে গিলে খায় !!
তুই ছাড়া সাগরের জল কাঁদে সহসাই
তোর ছায়া ছড়িয়ে দেয় শুধু রোশনাই
তোর নামে জ্বলে তারা বিরহী সন্ধ্যায়
রাতের আকাশটা আলোকিত হয়ে যায় !!
বা
বা আ মার বা বা
খান মেহেদী মিজান
যার ঔরসে পৃথিবীতে এসেছি
জন্মদাতা তিনি বাবা,
তাঁর আদর্শে যতক্ষণ চলি
পাই মান মারহাবা।
বাবার হাত ধরে প্রথম দাঁড়িয়েছি
এ ধরাধামে ভূমি ’পরে,
শীরদাড়া করে হেঁটেছি সম্মুখে
টলাতে পারেনি কোনো ঝড়ে।
বাবা ছিল আমার মাথার ওপরে যেন
ছাতা ও বৃক্ষের ছায়া,
রোদ বৃষ্টি ঝড় যেতো বাবার ওপর
আহা! কী-যে মিষ্টি মায়া।
হাটে গেলে বাবা মাঠে গেলে বাবা
প্রতিক্ষায় রয়েছি চেয়ে,
যখনি বাবা বাড়ি ঘরে ফিরেছে
আমি গিয়েছি ধেয়ে।
পকেটে কিছু থাক বা না-থাক
তাঁর বুকে রাখলে মাথা,
ক্ষুধা তৃষ্ণা ভুলিয়ে দিত তাঁর
ঘামের ঘ্রাণের কাথা।
বাবাকে হারিয়ে ২৫ বছর আগে
বাড়ি ঘর শূন্য খা খা,
নিতে যাই খবর বাবার কবরে
যেখানে তাঁর দেহ রাখা।
সেই থেকে আর পাইনি আদর
বাবার মতো কারো থেকে,
সেই যে গেল আর এলোনা
আমাকে এতিম রেখে।
জিগাই রাতের আসমানী তারাদের
কোথারে আমার বাবা?
তারারা বলে: স্রষ্টার কাছে আছে
বল: শুকরিয়া মারহাবা।
যেখানেই থাকো বাবা খুব ভালো থেকো
এই দোয়া কামোনা করি,
তোমার মতো সহজ সরল আর
স্বচ্ছ জীবন যেন গড়ি।
বা বা
ইয়াসিন আযীয
যতদিন শক্ত হাতে হাল ধরতে পারিনি
ততদিন তিনি আমার হাতে বৈঠা তুলে দেননি
হতে পারে সেটা নৌকার বা জীবন যুদ্ধের—
তিনি আমার পিতা।
মক্তবে আরবি শিক্ষা, প্রাথমিক পর্যন্ত
বাংলা, গণিত ও ইংরেজি পাঠ;
স্লেটে হাতের লেখা চর্চা
খাতায় প্রথম কলমের ব্যবহার
সাঁতার শেখা—সব প্রথমেই তিনি ছিলেন।
তিনি আমার জন্মদাতা।
ন্যায়ের পথে চলা, সত্য কথা বলা
দেশপ্রেম, মানব সেবা যিনি শিখিয়েছিলেন
তিনি আমার অভিবাবক ছিলেন।
একদিন বাবা আর আমি নদী পার হতে
ঘাটে গেলাম। খেয়া নৌকা মাঝ নদীতে
মাঝি নৌকা ঘুরিয়ে দিলো! বাবা ডাকেননি তাকে
‘এতদূর এসে ফিরে যাও’—মাঝিকে সবাই শাসাতে থাকে;
মাঝি চিৎকার করে আর বলে
‘আমি জানি, আমি আনতে যাচ্ছি কাকে!’
বাবা একজন ভালো মানুষ ছিলেন।