সুলতান মাহমুদের একগুচ্ছ কবিতা

সুলতান মাহমুদের একগুচ্ছ কবিতা০১.নির্বাসিত কবি মাহমুদ দারবিশকে

হে নির্বাসিত কবি, আমি তোমাকে নিয়ে একটি কবিতা লিখতে চেয়েছি

অথচ আমিতো তোমার মত নির্বাসিত নই

আমিতো জানিনা নির্বাসন যন্ত্রণা কেমন?

যেমনটা তুমি জেনেছ কিছু বুঝে উঠার আগেই।

এখনো তোমার কল্পনায় খেলা করে গ্যালিলির স্মৃতি

জলপাই গাছের সারি, কমলা, বাদাম, দ্রাক্ষাকুঞ্জ, সমতল ভূমি, সমুদ্রতীর

তোমাকেতো আমি তোমার দেশ ফিরিয়ে দিতে পারিনা

আমি শুধু পারি তোমার বিগত দিনের স্মৃতিগুলো জাগিয়ে দিতে।

হে নির্বাসিত কবি, নির্বাসন যন্ত্রণা কেমন তা আমি জানিনা

তবে আমি অনেক নির্বাসনের গল্প শুনেছি।

নবী ইউসুফ যেমন হয়েছিল নির্বাসিত, কুয়ার অতল হতে মিশরে

তেমনি তুমি হয়েছ নির্বাসিত নিজ ভূমে, পর ভূমে।

কবি, এ নির্বাসনতো আদিকাল হতেই চলে এসেছে

চকচকে ক্ষমতার লোভ, ভূমির লোভ, স্বর্ণের লোভ, তেলের লোভ।

পৃথিবীর পরতে পরতে নির্বাসনের তিক্ত ইতিহাস।

সাতচল্লিশ, একাত্তর সর্বশেষ নাফ নদীর রক্তাক্ত সীমানায়।

কবি, তুমি বলতে পার তাই বলে গেছ তোমার নির্বাসন যন্ত্রণা

অথচ কজন আর এমনটা পেরেছে উগড়ে দিতে তার যন্ত্রণার ইতিহাস?

হে নির্বাসিত কবি, আমি ফিলিস্থীন দেখেনি

আমি তোমার কবিতা পড়েছি

তোমার কবিতাই আমার কাছে ফিলিস্থীন

তোমার ক্রোধ-ই আমার কাছে ফিলিস্থীন

তোমার নির্বাসন যন্ত্রণাই আমার কাছে ফিলিস্থীন।

তোমার কবিতাই ফিলিস্থীনের মানচিত্র

ওরা ফিলিস্থীনের নামকে মুছে দিতে চায়

অথচ তোমার কবিতার প্রতিটি লাইন ফিলিস্থীনকে জাগিয়ে তুলবে

তোমার হৃদয় যেন ফিলিস্থীনের হৃদয়!

যে হৃদয় পৃথিবীর তাবৎ নির্বাসিত মানুষের প্রতিনিধি।

 

০২.যে বাড়ি ছাড়ে

যে ছেলেটা একবার বাড়ি ছাড়ে

তার আর কোনদিন হয় না ফেরা বাড়ি

তেমন করে, যেমন করে সে

স্কুল ব্যাগ ছুড়ে ফেলে দৌড়ে ছুটবে মাঠে

তার উচ্ছ্বসিত বিকেলের উচ্ছ্বাস

পৃথিবীর সব প্রজাপতির ডানায় জাগাবে শিহরণ

তার দুষ্টমি, বাড়ি পালানো, মায়ের বকুনি

কিংবা সেই শৈশবের বন্ধুদের সাথে কাটানো সময়

আর ফিরে আসে না কোন দিন।

যে দুরন্ত ছেলেটা ঘর ছেড়েছে একদিন

আগামীর সোনালি সময়ের খোঁজে

হয়ত সে আর জানবে না কোনদিন

সোনালি সময় সে পিছনেই রেখে গেছে!

যে ছেলেটা একবার পেরোয় গৃহের চৌকাঠ

বাকি সময় সে খাবি খায় পৃথিবীর নানা প্রান্তে

তার ক্যারিয়ার হয়, খ্যাতি হয়, নাম যশ সব হয়

কিন্তু আর বাড়ি ফেরা হয় না তেমন করে!

যে ছেলেটা পৃথিবীর সব মায়া পিছনে ফেলে

ছাড়ল বাড়ি

হয়ত তার জানাযা হবে অন্য কোথাও

অন্য কোন দেশে, অন্য কোন খানে

তবুও নিয়তির খেয়ালে যদি কেউ ফিরে বাড়ি

সে বাড়ি আর তার রেখে যাওয়া বাড়ি থাকে না

সেখানে তার শৈশব থাকে না, তার উচ্ছ্বাস থাকে না

সে হয় বাড়িতে আগত নতুন এক অতিথি!

তাইযে ছেলে একবার বাড়ি ছাড়ে

সে আর কোনদিনই ফিরে না তার বাড়ি!

 

০৩.আমার নবী থাকেন

আমার নবী থাকেন আমার বড় কাছে

যেথায় পদ্ম পুকুর নিরব জল টলমলে

যেথায় দীঘির জলে মাছেরা জিকির করে

বিলের ঝোঁপে পোকা মাকড় খোদারে স্মরে!

 

আমার নবী থাকেন আমার বর্ষা জলে

গ্রীষ্মের নীরব দুপরে আমার মনের ধেয়ানে

আমার নবী থাকেন শরৎ নীলে সাদা কাশে

হেমন্তের ধানের ক্ষেতে কচি কচি সবুজ ঘাসে

আমার নবী থাকেন কনকনে শীতে তাহাজ্জুতে

বসন্তের কোকিলের গানে হাজার ফুলের মাঝে

 

আমার নবী থাকেন মাঝ দরিয়ার ঢেউয়ের দোলে

ভীষণ ঝড়ে যখন আকাশ ফুঁসে ওঠে ভীষণ ক্রোধে

আমার সকল কল্পনাতে আল্পনাতে স্বপ্ন দেখা স্বপ্ন মাঝে

আমার নবী থাকেন সকাল সাঁঝে সকল কাজে আমার মাঝে।

 

০৪ শিম ফুল

শিম ফুল ফুটে আছে নিরালায়

ভ্রমর গান গেয়ে যায় সুরেলায়

শিম পাতা ভরে আছে শিশির কণায়

মাকড়সা চুপিসারে জাল বিছায়

শিম ফুল ফুটে আছে নিরালায়।

কে হায় কার পানে ফিরে চায়

কুয়াশারা বিষাদে ঝরে যায়

কার বুক ভরে আছে বেদনায়

কার মনে ভরে গেছে নীল ব্যথায়

সেই খোঁজ কে আর রাখে হায়

শিম ফুল ফুটে আছে নিরালায়।

পলাতক পাখি কেন ফিরে চায়

বিড়ালেরা বসে আছে ভিঁজে কাঁথায়

গাজায় শিশুরা হায় কেমনে ঘুমায়

মরা শিশুর গালে তবু মা চুমায়

শিম ফুল ফুটে আছে নিরালায়।

মাঝ রাতে চাঁদ মেঘেতে হারায়

বট গাছে প্যাঁচা একা কেঁদে যায়

প্রহরীর ঘুম ভাঙে কুকুরের কান্নায়

কার মানিক শীতে কাঁপে রাস্তায়

শিম ফুল ফুটে আছে নিরালায়।

খেঁজুরের পাতা চুয়ে রস ঝরে যায়

বাঁদুরেরা কোথা ছুটে চলে হায়

শুকতাঁরা জ্বলে আছে বাঁশ ডগায়

শীতে ঘরে থরো থরো কার বুড়ো মায়

শিম ফুল ফুটে আছে নিরালায়।

 

০৫ পাখির ঠোঁটে সভ্যতা

মানুষ তো পাখির ঠোঁটে লেগে থাকা বীজের মত

যে পাখি আজ আন্দামানের দ্বীপে

সে পাখিই হয়ত রেখেছে বীজ চিম্বুক পাহাড়ে!

এই যে বীজ হতে বেরিয়ে এল এক বৃক্ষ

সেকি জানে কোথায় ছিল তার জন্ম রেখা?

বাংলার কুচুরি পানাও নাকি লাতিন দেশ হতে

বাচ্চা কাচ্চা দিয়ে ভরেছে আমার খাল বিল!

এইভাবে চলছে বৃক্ষের বংশধারা

কখনো পাখির ঠোঁটে, কখনো জলে ভেসে!

 

আমাজনের কোন প্রজাতিই হয়ত বেড়েছে

আমার বাড়ির ধারে কোন ঘন বনের ফাঁকে!

 

এই পাখির ঠোঁটের বীজের মত আমরাও

ছুটেছি পৃথিবীর প্রান্তরে হাজারো শতাব্দী ধরে

মায়া সভ্যতার কোল হতে সিন্ধু নদের দেশে

মেসোপোটেমিয়ার ফোরাত হতে পদ্মার পলিতে!

 

এই যে আমি এলাম এখানে এই সুবর্ণভূমে

হাজার বছর আগে ছিল কোথা আমার রক্তধারা

হয়ত কোন ফিনীশদের জাহাজে চেপে

হয়ত কোন আরব্য নাবিকের পথ ধরে!

 

পৃথিবীর মানুষেরা যুগে যুগে ছুটেছে

এতটুকু নিরাপত্তা, আশ্রয়, খাদ্যের খোঁজে

সেতো আজন্ম যাযাবর, আজন্ম অভিবাসী

ছুটছে নানা প্রান্তরে পাখির ঠোঁটে ঠোঁটে!

 

আজ যাযাবর মানুষ এঁকেছে বিভেদের সীমানা

পাসপোর্ট ভিসার আড়ালে বন্দী মানব সভ্যতা!

 

০৬ তাহার মন খারাপ হইলে

তাহার মন খারাপ হইলে

একটু পাশে বইস

একটু হাসি মুখে কথা বইল

তারে বইল আসমানে খালি

সাদা মেঘই ভাসে না

মাঝে মাঝে আসমান কালা হইয়া

প্রচণ্ডরকম ঝড়ও আহে।

তারে বইল শিমুল তুলার গাছে

নরোম তুলা যেমন, তেমন কাটাও থাহে

তারে বইল পদ্মার গাঙ্গে ইলশা মাছের লগে

চইরণও পড়ে, ঘরও ভাঙ্গে।

তাহার মন খারাপ হইলে

তাহার মাথায় হাত বুলাইও

জ্বর আসলে একটু জলপট্টি দিও।

শক্ত কইরা তাহার হাত ধইর

তারে বইল আমিতো আছি!

 

০৭ ইউরেকা

একটি কাটা মন্ডু পড়ে আছে

ঘুমিয়ে আছে মহান বিজ্ঞানী আর্কিমিডিস!

যুদ্ধে জয়ী রোমান সম্রাট; দুঃখ ভরা কন্ঠ

অবনত মস্তক, ভিজে যাওয়া চোখে

তাকিয়ে আছে নির্ণিমেষ।

আহ্! আমি তোমাকে মারতে চাইনি

যদিও তোমারি জন্য বছরের পর বছর

ধ্বংস হয়েছে আমার যুদ্ধ জাহাজ

তোমার আবিস্কৃত আয়নায় পুড়ে মরেছে রোমান সৈনিক

তবুও আমিও তোমায় মারতে চাইনি।

আমি চেয়েছি তুমি বেঁচে থাক

আমি শুধু তোমায় দেখতে চেয়েছিলাম

এমন মেধাবী মানুষও হয়

এমন মহান, এতটা গুণের অধিকারী!

আমি গুণের কদর জানি, অথচ;

কি কান্ড ঘটাল মাথা মোটা রোমান সৈনিক!

সিসিলির প্রতি আমার আক্রোশ ছিল

কিন্তু তোমাকে হত্যার অভিপ্রায় ছিলো না।

 

তুমি মাটিতে আঁকিবুঁকি করছিলে

জ্যামেতির নানা কারুকাঁজে ব্যস্ত

ওদিকে সিসিলি দখল হয়ে গেছে

আত্মভোলা বিজ্ঞানী সে তুমি জানো না!

দাঁড়ালেন সম্মুখে বিজয়ী রোমান সৈনিক

উঠে দাঁড়াও, চল আমার সাথে

জ্যামিতির নেশায় বুঁদ আর্কিমিডিস

দেখছ না কাজ করছি, ভাগো এখান থেকে।

বিজিত সৈনিক, এ অপমান সইবে কেন

এক মহান বিজ্ঞানীর মাটিতে আঁকিবুঁকির সে কি বুঝে?

এক কোপে ঘাড় হতে মাথা আলাদা

মারা গেলেন মহান বিজ্ঞানী আর্কিমিডিস!

 

আহ্! আমি বিজয়ী সম্রাট হয়েও

তোমার কাছে পরাজিত হে মহান বিজ্ঞানী!

তোমার প্লবতার সূত্র বদলে দিয়েছে জাহাজ শিল্প

যেদিন তুমি ইউরেকা বলে দৌড়ে ছিলে

সিসিলির পথে এক পাগলের মত

সেদিন পৃথিবীতে রচিত হয়েছিল নতুন ইতিহাস!

 

আহ্ আর্কিমিডিস!

পৃথিবী আমায় মনে রাখবে তোমার হত্যার দায়ে

অথচ, তোমার রেখে যাওয়া জ্ঞান ভান্ডার

যুগে যুগে করবে তোমায় মহমান্বিত।

এখানেই সম্রাটেরা হেরে যায় জ্ঞানীদের কাছে!

 

০৮ প্রেম

যে প্রেমে পড়ল

সে ভাবল প্রেম মানে কিছু অনুভূতি

কিছু হরমোনের বিচ্ছিন্ন নড়াচড়া

মগজের কোনে চিনচিন ব্যথা

হৃদয়ের অলিন্দে শত ফুল ফোটা।

 

সে জানল প্রেম এক ভরা বর্ষা

এক বর্ষণ মুখর বিকেল

বারান্দায় বসে আনমনে এক কাপ চা

একটা কবিতার বই, একটা হলুদ খাম

 

যে প্রেমে পড়ল

তার চোখে সবটাই আলো

নিকষ অন্ধকার, কুহুকের মায়াজাল

প্রতারণার ছায়া, সবটাই জাগায় মায়া

 

সে জানল প্রেম এক প্লেট আবেগ

প্লেটের পান্তাকেও মনে হয় কাচ্চি বিরিয়ানি

সে শূন্যতায় পূর্ণতার জাল বুনে, মৃদু হাসে

কল্পনার রথে চড়ে পাড়ি দেয় সপ্ত সিন্ধু নদ!

 

যে প্রেমে পড়ল

তারে যে বাঁধল না অসীম ক্ষমায়

তার শত ত্রুটি এড়ালো না নীরব উপেক্ষায়

সে জানুক সে ভুল পাত্রে জানিয়েছে প্রণতি।

 

প্রেম আর কিছু নয়

শুধুই ক্ষমা, অবিরাম ক্ষমা।







إرسال تعليق (0)
أحدث أقدم