শিনরিন ইউকু :: মোহাম্মদ বায়েজিদ
প্রকৃতির
মাঝে গিয়ে মনের গোসল নেওয়ার প্রাচীন জাপানিজ একটা পদ্ধতির নাম ‘শিনরিন ইউকু’। মনের
গোসল মানে মনের এমন একটা রিফ্রেশমেন্ট যা যাবতীয় মানসিক চাপ, ক্লান্তি, মন খারাপ
এসবকে কমিয়ে দেয়। যেভাবে পানি ও সাবান-শ্যাম্পু দিয়ে গোসল করলে শরীরের ঘাম, ময়লা,
ক্লান্তি দূর হয়ে যায়। জাপানিজ অনেক চিকিৎসকরাই রোগির মানসিক ফ্রেশনেসের জন্যে
শিনরিন ইউকু প্রেসক্রাইব করে। জাপানিজ শব্দ শিনরিন অর্থ forest বা জঙ্গল এবং ইউকু অর্থ bathing বা গোসল।
সবচেয়ে
ভালো হয় যদি প্রতি সপ্তাহে অন্তত দুই-একটা দিন সময় করে যাওয়া যায়। গাছেদেরকে দেখা,
পাখির ডাক শোনা, মৃদুমন্দ বাতাস, গাছের ফাঁক-ফোকর দিয়ে উঁকি মারা সূর্যের আলো,
মাটির গন্ধ এই সমস্ত কিছুকে অনুভব করা। মোট কথা নিজেকে জঙ্গলের বা অরণ্যের অংশ করে
ফেলা। সবুজ গাছপালার দিকে মানুষ দীর্ঘক্ষণ তাকিয়ে থাকলে দৃষ্টি শক্তির উন্নতি
হয়।
জঙ্গলের
পরিবেশ অনেক ঘটনাময় এবং সমৃদ্ধ হয়। একটা পিপড়ার দিকে তাকালেই দেখবেন তার জীবন কতো
ব্যস্ততাপূর্ণ, কতো কাজ তার। নিবিড় মনোযোগ দিয়ে খাবার খুঁজতে থাকে। খাবার খুঁজে
পাওয়া গেলে সাথিদেরকে সংকেত পাঠায়, ডেকে আনে। গাছের কচি পাতা দক্ষতার সাথে কেটে
নিয়ে যায়। আপনি হাত দিয়ে তার পথ রোধ করে দেখবেন, আরো বেশি গতি নিয়ে সে অন্য পাশ
দিয়ে পথ তৈরি করে চলে যাচ্ছে। দলবদ্ধতা, পরিশ্রম, ডিসিপ্লিন, শক্তি এসবের চমৎকার
উদাহরণ পিপড়া। একটা পিপড়া তার ওজনের ছয় গুণেরও বেশি ভারী জিনিশ নির্বিঘ্নে নিতে
পারে।
পাখিদের
দিকে তাকান—কী অসম্ভব সুন্দর বর্ণবৈচিত্র্য, কী ফুরফুরে আনন্দে নেচে বেড়ায়
তারা। খাবার খোঁজা বা প্রয়োজন ছাড়াই দেখবেন এক জোড়া পাখি এই ডাল থেকে ওই ডালে ছুটে
বেড়াচ্ছে। প্রথমে একটা পাখি যাচ্ছে, সেটাকে অনুসরণ করে আরেকটা যাচ্ছে, যেনো অদ্ভুত
এক ছোটাছুটির খেলা। কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলে এই আনন্দ নিজের ভেতরেও ছড়িয়ে পরে।
প্রতিটা
ঘাস, গুল্ম, শেওলা, শামুকের খোলস, ফুল, ফল, বীজ সব কিছুর আলাদা আলাদা আবেদন আছে।
আছে আলাদা আলাদা জীবনশৈলী, আবার এই বনে সবাই মিলে মিশে একাকার। সহাবস্থানে
পারস্পরিক সহযোগিতা করে সবাই বেঁচে আছে৷
গাছ
এতো মমতা নিয়ে ফুল ফোটায়, ফুলের মাঝে মধু তৈরি করে এই আশায় যে, কীটপতঙ্গরা ফুলের
সৌন্দর্য এবং মধুর প্রতি আকর্ষিত হয়ে আসবে আর তার পরাগরেণুগুলো ছড়িয়ে দেবে অন্য
ফুলে।
বীজ
এর চারদিকে সুস্বাদু ফল তৈরি করে, যাতে পাখিরা বা অন্য প্রাণীরা সে ফল খেয়ে বীজকে
ছড়িয়ে দিতে পারে দূরে। যে পর্যন্ত মা গাছটা পৌঁছাতে পারে না। এভাবেই গাছেরা তাদের
বংশধারা বজায় রাখে, বিস্তৃত করে। আবার কিছু গাছ যেমন ছাতিম, শিমুল এসব গাছে
সুস্বাদু ফল হয় না, কিন্তু বীজের সাথে হয় এক রকম তন্ত্র যা বীজকে বাতাসে ভেসে
থাকতে সাহায্য করে আর বাতাস তাকে উড়িয়ে নিয়ে যায় অনেক দূড়ে।
কাঠঠোকরা
পাখিরা পোকা খাবার আশায় গাছের শুকনো ডালে গর্ত করে। সেই গর্তে পরবর্তীতে অন্য
পাখিরা এসে বাসা বাধে।
যেখানে
সূর্যের আলোর পরে সেখানে গাছেরা বেড়ে ওঠে নির্বিবাদে। আবার যেখানে সূর্যের আলো খুব
একটা পৌঁছাতে পারে না সেখানেই ঠিকেই ধীরে ধীরে শেওলা যায়গা করে নেয়—যাদের খুব বেশি রোদের দরকার হয় না। সেই শেওলার নিচে আবার
নানান কিট পতঙ্গরা আস্তানা গাড়ে। এভাবেই সবাই মিলেমিশে এক অদ্ভুত সুন্দর পরিবার।
কিছুক্ষণের জন্যে এদের মাঝে হারিয়ে গেলে নিজের অজান্তেই মনের ভেতরের অশান্ত অংশটা
ধীরে ধীরে শান্ত হয়ে আসে। আমাদের থাকার ঘরটা গোছালো হওয়া যতোটা জরুরী তার চেয়ে
বেশি জরুরী মনের ভেতরটা গোছালো হওয়া। নাগরিক যান্ত্রিক জীবনের ব্যস্ততা যখন আমাদের
মনকে অস্থির করে ফেলে, মনোযোগ দেবার ক্ষমতা, ধৈর্য শক্তি সব কিছুকে কমিয়ে দেয়,
চিন্তা গুলোকে টুকরো টুকরো করে ভেঙে ছড়িয়ে ছিটিয়ে ফেলে। তখন এমন একটা যায়গার দরকার
হয় যেখানে এই সব কিছুকেই আবার সংগঠিত করা যায়, পুনর্বিন্যস্ত করা যায়—জঙ্গল ঠিক তেমনি একটা যায়গা।
জঙ্গলে
একটা লম্বা সময়ে কাটিয়ে যখন ফিরে আসবেন দেখবেন হয়তো আপনার জামাটা অপরিচ্ছন্ন হয়ে
উঠেছে। কিন্তু মনটা দেখবেন তাকে যতোটা অপরিচ্ছন্ন অশান্ত নিয়ে গিয়েছেন তা অনেকটা কমে
গিয়ে একটা শান্ত, ধৈর্যশীল, গোছালো একটা মন নিয়ে আপনি ফিরে এসেছেন।