কীর্তিনাশার কাব্য :: মে দিবস সংখ্যা
১লা
মে এবং আইএলও
চারু হক
আপনি অবশ্যই এটা জেনে অবাক হবেন না—১লা মে দিবসে যাবতীয় অফিস-আদালত বন্ধ থাকলেও শ্রমিক অধিকারের
সর্বোচ্চ সংস্থা আইএলও (আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা) স্বয়ং এই দিনটাকে পালন করে না!
মহান দিবস নিয়ে এ যেন এক মহান
প্যারাডক্স: আইএলও’র কর্মীরা লেবার বা শ্রমিক নন, তারা লেবার ল্যাবরেটরির ডাক্তার।
তাদের হাতে সার্জিক্যাল গ্লাভস নয়, মাউস-প্যাড; অপারেশন থিয়েটার নয়, এয়ার-কন্ডিশন
কক্ষে প্রেজেন্টেশনের স্লাইড। সেখানে তারা ‘শ্রম’ হিসেবে কাগজে পরিসংখ্যানের
ফর্মুলা কেটে শ্রমিকের জীবনের গল্পকে ডাটা পয়েন্টে পরিণত করেন। ‘ওভারটাইম’? সেটা
তো শুধু ফ্যাক্টরির শ্রমিকের জন্যে; আইএলও’র হোয়াইট কলার হিরোরা তো ‘প্যাশন’ দিয়ে
রাত জেগে রিপোর্ট লেখেন!
আসলে এটা শ্রেণী-দর্শনের এক অদ্ভুত
মোনোলিথ। আইএলও নিজেকে ছুটির নীতিনির্ধারক মনে করে বিধায়, সেই ছুটি উপভোগ করা তার
জন্য মর্যাদাহানির শামিল। এবং নিজেকে এইভাবে মহিমান্বিত করতে গিয়ে জাতিসংঘভুক্ত এই
দোকানিরা শ্রম ও শ্রমিকের সংজ্ঞা এতটাই সংকীর্ণ করে রেখেছে যে, সমাজের বিরাট একটা
অংশকে বাদ দিয়েই তারা এতগুলো বছর ধরে ‘বিশ্ব শ্রমিক সংহতি’র নীতিকথা চালিয়ে
যাচ্ছে। এমনকি এরা এখন এদের অফিসের দেয়ালে হাতুড়ি-কাস্তের ক্লাসিক পোস্টারও টানিয়ে
রাখে না। সেখানে বরং শোভা পায় ‘গ্লোবাল লেবার স্ট্যান্ডার্ডস’-এর ফ্রেমবন্দি কাগজ,
যেখানে ‘শ্রমিকের অধিকার’-এর কথাসাহিত্য লেখা। এবং যাদের হাতে সেইসব কাগজ লেখা হয়,
তাদের হাত কখনই ঘামে না।
জাগো
মোদাচ্ছের হোসেন
জাগো,
শ্রমিক, কৃষক, মেহনতি ভাই
শ্রমদাসত্বের
উচ্ছেদ চাই
মানুষের
মতো বাঁচতে চাই।।
জাগো,
শ্রমিক, কৃষক, মেহনতি ভাই
আমাদের
শ্রমে গড়া এই পৃথিবী
আমাদের
শ্রমেই গড়া এই সভ্যতা
তবু
আমাদের নেই কোন মালিকানা
মানবো
না, আমরা মানবো না
মেটাবো
লেনদেন, এসো সবাই।।
জাগো,
শ্রমিক, কৃষক, মেহনতি ভাই
শোষণের
জাঁতাকল ভেঙ্গে দাও
শোষকের
মসনদ গুঁড়িয়ে দাও
আমরা
নিঃস্ব নেই হারাবার ভয়
ছুটে
এসো, এসো সবাই
উৎপাদনের
মালিকানা চাই
সমস্বরে
বলো—সাম্য চাই।।
জাগো
শ্রমিক-কৃষক-মেহনতি ভাই
অদেখা শ্রমিকের পানে
সুলতান মাহমুদ
সভ্যতার
সু-উচ্চ মিনারের দিকে তাকিয়ে
পিছনে
ফেলে আসা ইতিহাসের বাঁকে বাঁকে
আজো
কান পেতে শুনি তোমাদের গান
যাদের
হাতুরি-শাবলে ভেঙেছে জ্বরার তান!
মহেঞ্জোদারো,
হরপ্পা কিংবা ইউফ্রেটিসের তীরে
গড়ে
উঠা মেসোপটেমিয়া সভ্যতা
আজো
বলে যেন তোমাদের কথা!
ঐ
পিরামিডের মিনারের প্রতিটি পাথর
ফারাওদের
বয়ে চলা ইতিহাসের আঁচড়
হায়ারোগ্লিফিক্স
রূপে গুহার দেয়ালে
লিখে
গেছে স্তুতি তোমাদের খেয়ালে!
হে
আফ্রিকার কালো ক্রিতদাসেরা
তোমাদের
খঞ্জরের আঘাতে জেগেছে ধরা!
ওরা
স্বীকার করুক আর না করুক
পাথরের
গভীর খাঁজে লেখা সে কথা!
প্যারিসের
আইফেল টাওয়ার কিংবা বাকিংহাম প্যালেস
মালয়শিয়ার
পেট্রনাস টাওয়ার কিংবা ব্রুজ দুবাই
নেবু
চাঁদ নেজারের ঝুলন্ত উদ্যান কিংবা কুতুব মিনার
ওগো
শাহজাহানের ভালোবাসায় মমতাজের তাজ
তোমাদের
রূপে আমরা যতটা অবাক
তারচেয়ে
বেশি বিস্ময়ে তাকাই সে অদেখা শ্রমিকের পানে!
জুতা
নকিব মুকশি
জুতা ক্ষয় হলে গেলে
পা কঙ্কর বা কাঁটায়
রক্তাক্ত হয়,
জীবনবাগানে নেমে আসে
অ্যাসিড বৃষ্টির মতো
ম্যাক্স এনট্রপি, তবু
পা যুগল
ক্ষয় করে যায় নতুন
জুতাদের!
ফসলি জমিতে অস্ত্রাগার
করে
পায়েরা খোঁজে কালো
রসুন!
তা দেখে পাশেই হাসে
মাটি
হা হা হা…রসুন…হা হা
হা…
পা এতই বজ্জাত—
যে জুতা এত দিন বুক পেতে
পাথর, পেরেকের ঘা
সহ্য করে এসেছে কেবল
পাকে সুরক্ষিত রাখতে,
সেই
পা-ই আজ তাকে
ছুড়ে ফেলে দিল ভাগাড়ে!
তুলে নিল নতুন জুতা
তার বুকে ঘা দিতে দিতে
ক্ষয় করাতেই তার যেন
মহানন্দ, অথচ তাকে ছাড়া
এক পা সামনে বাড়ানোর
তার
কোনো মুরোদ নেই, সত্যি
নেই
অথচ পা জানে না—
ক্ষুদ্র প্রাণী
টার্ডিগ্রেট
১৪৯ ডিগ্রি তাপও
সহনশীল,
বেঁচে থাকতে পারে
মাইনাস ২৭২ ডিগ্রি
ঠান্ডাতেও
ক্ষুদ্র তো ক্ষুদ্র নয়,
ক্ষুদ্র—
হেমার্কেট স্কয়ারেও
বুক উঁচু করে দাঁড়িয়ে
যায়
পৃথিবীকে পাল্টে দেয়
ম্যাককরমিকে সমবেত
কণ্ঠে
এই সব স্পার্ম ব্যাংক
মূলত জুতাদের দৌলতেই পূর্ণ
খোজাদের দুনিয়া গড়ে দেয়
পাল্টে যায় পৃথিবীর
মানবেতিহাস
তবু নিয়তি এমন—
জুতারা দিন শেষে বুক
ফুলিয়ে
সমবেত হয় পায়ের
সাম্রাজ্য
টিকিয়ে রাখতেই
এরই নাম পৌনঃপুনিক
নিয়তি…
মে ডে
সৈয়দ নাজমুল
আহসান
বছর
ঘুরে
শ্রমিকের
ঘরে
এসেছে
মে ডে
শোষিত-বঞ্চিত
জনতা
হাতে
তুলে নে
মুক্তির
মশাল।
অন্ধকার
ঘুচিয়ে
আলো
জ্বেলে দে
সংগ্রাম
বিশাল।।
শ্রম
দিবস
খান মেহেদী মিজান
ওরা
গরীব শ্রমিক বলে
রাত
দিন কারখানা কলে
কাজ
করিয়ে ঘাম ঝরিয়ে
মালিক
কোটিপতি।
পেটটা
পুরে দেয় না খেতে
বাধ্য
করে কাজে যেতে
কথায়
কথায় শোষণ করে
নেইকো
ওদের গতি।
নেইতো
কোনো স্বাস্থ্যনীতি
জীবন
ক্ষয়ের আছে ভীতি
শিশুশ্রমে
মালিক জিতে
ওদের
করে ক্ষতি।
দেশ
ও জাতির উন্নয়নে
দু’হাতে
কাজ যায় বয়ানে
শ্রমিকরা
না খাটলে হবে
করুণ
পরিণতি।
রক্ত
ঘামে পানি করে
দেহের
শক্তি যাচ্ছে ঝরে
মজুরি
দাও ঘাম শুকানোর
আগে—ধর্ম নীতি।
শ্রমজীবী
নারী
খান নজরুল ইসলাম
প্রতিদিন সন্ধা নামে
থরথরে বুক...
পায়ে হেঁটে ঘরেফিরে
জোস্নার সুখ!
সারাদিনই হাহাকার মা’ছাড়া
ঘর...
জোস্নাদের কাছে যেন
সবকিছু পর!
ধরিয়া আদরে গলা চুমু
খায় মা’কে
সারাদিন একা থাকি মা
কোথা থাকে?
মায়ের আদর বুকে, চোখে
থাকে জল
‘কাল কাজে যাবে না, বল
মা তুই বল!
মা তুই এমন কেন? থাকিস
একাএকা
সারাদিন কেটে যায় পাই না
যে দেখা ‘
অনাহারে থাকা ভালো থাকে
যদি মা
তোর আদর পেলে মা,
ক্ষুধা লাগে না!
জড়ায়ে ধরিয়া মা’য়ে চুমো
খায় গালে
নয়ন ভরিয়া ওঠে তার,
নয়নের জলে!
কাল কোথা যাব না-কো কথা
দেই তোরে
কথা রাখা হয় না মা’র
পরদিন ভোরে!
প্রতিদিন একই রূপে ‘কর্মজীবী
নারী’
বুকেতে বাধিয়া কাঁপন
ফিরিছে বাড়ি!
ভোরের নীরবতায় ভয়ে
কাঁপে বুক
ঘরে রেখে সুখটাকে, কিনে
নেয় সুখ!
সন্ধা নামিলে আবার
থরথরে বুকে
ঘরকষ্ট মুছে দিলেন
জীবনের সুখে!
সন্তানেরে সুখ দিতে এ-কি
বিসর্জন?
স্বীয় কষ্ট বুকে চেপে
জীবনযাপন!?
‘শ্রমজীবী নারী’ তুমি
জগৎশ্রেষ্ঠ মা
পুজিলে তোমাকে নারী জাত
যাবে না!
অবহেলা ঘষেমেজে সমৃদ্ধ
হও নারী
সুসন্তান গড়িলে পাবে,
সুখভরা বাড়ি!
তোমার এ মহাত্যাগে
অহংকারে বুক
ক্ষণেক্ষণে নেচে ওঠে
বাংলা মায়ের মুখ!
মানুষ হলাম না
ইয়াসিন
আযীয
দাস
অথবা ক্রীতদাস থেকে শ্রমিক হলাম
বাহ্
কী বাহারি নাম পেলাম!
সারাদিন
গায়ে খাটি—শুকায় না ঘাম;
করুণা
চাই না; চাই ন্যায্য মজুরি-দাম।
তোমাদের
সুখি দেখে খুশি হই আমি
নিজের
সুখ খুঁজি না।
সভ্যতা
গড়ে যাই মুষ্টি হাতে
তবুও
তোমাদের নামই লেখা সোনার পাতে!
শ্রমিকের
নাম কেউ খোঁজে না;
শ্রমিকের
দুঃখ কেউ বোঝে না।
পিরামিড,
তাজমহল থেকে হালের পদ্মা সেতু
হাতুড়ি,
শাবলের সাথে আমারই ঘামে ফুল ফোটে
লাঙ্গল,
কাস্তে হাতে নিয়েছি বলেই
ফসলের
ছড়াছড়ি দেখো বিরান মাঠে।
কড়াপড়া
হাতে সন্তানের মুখে পুরি এক টুকরো রুটি
এটুকুই
সুখ, এতটুকুই সন্তুষ্টি।
তবুও
বিনাদোষে গালি দাও, করো প্রবঞ্চনা।
দাস
অথবা ক্রীতদাস থেকে শ্রমিক হলাম
আপসোস
মানুষ হলাম না!
মে
দিবসের ছড়া
ইব্রাহিম খলিল
গাঁইতি
কোদাল শাবল হাতে
ঝরায়
যারা ঘাম
দিনের
শেষে সন্ধ্যে বেলা
পায়
না ঘামের দাম।
যেই
শ্রমিকের ঘামে গড়া
অট্টালিকা
দেয়াল
সেই
শ্রমিকের নিদান কালে
কেউ
রাখে না খেয়াল।
সময়
এবং মুজুরিটা
দুটোই
করে চুরি
ওদের
ঘাড়ে পারা দিয়ে
কামায়
ভুরি ভুরি।
যেই
শ্রমিকের শ্রম সাধনায়
অট্টালিকা
গড়ে
মজুরিটা
চাইতে গেলে
ঘাড়টা
চেপে ধরে।
এমন
জুলুম যায় কী সওয়া
হোক
প্রতিবাদ হোক
জেগে
ওঠো বুকে নিয়ে
মে
দিবসের শোক।
শিশুশ্রম
ডিএম শফিকুল
ইসলাম
হৃদয়
গভীরে রাজমুকুটের স্বপ্ন তার
আগামির
সোনালির;
চাঁদেন হাসি আর কৃষ্ণচূড়ার রঙে
রঙিন
জীবন গড়ার দীপ্ত প্রত্যয়।
গত
বসন্তে মায়ের হাতের শেষ রান্না
খেয়েছিল
সে,
আজ
কেন জানি মাকে খুব মনে পড়ছে।
ভয়ার্ত
কাঁপা কণ্ঠে তার হৃদয় নিংড়ানো আকুতি—
‘আমাকে কাল বাড়ি
যাবার দিবেন?’
অপর প্রান্ত
হতে রুদ্র কণ্ঠের বজ্র শাসানি—
অবশেষে
ফোসকা হাত আর হাড্ডিসার দেহে
পালানোর
ঊর্ধ্ব সাহস—
নিস্তব্ধ
পৃথিবীর শুনসান নীরবতা ভেঙে
বাতাসের
কানে বাজে নিষ্ঠুর বিষণ্ণতা।
বাহক
বাতাসে বেদনার সুর ভাসে
বেদনার
নীল পাখি বলে—‘তোর কপাল পুড়েছে।’
শ্রমের
মূল্য
রফিক ওসমান
হাতুড়ি, বাটাল, গাঁইতি,
শাবল
সংগে নিয়ে আমরা
সকাল দুপুর রোদে ঘামে
পোড়াই গায়ের চামড়া
।
কলকারখানা সচল রাখি
রক্ত করে পানি
শ্রমের মূল্য পাই না
তবু
টানি তেলের ঘানি ।
সত্য ন্যায়ের পক্ষে যখন
আওয়াজ আমরা তুলি
বুর্জুয়ারা
নির্বিচারে
চালায় তখন গুলি।
শ্রমিক
দিবস: ১লা মে
মোহাম্মদ সেকান্দার আলী
একলা ভোরে সূর্য উঠে,
করে নতুন পণ
শ্রমিকদের ঘামে ভেজা
প্রতিটি জীবন।
ঘাম ঝরে, হাতে উঠে
রক্তমাখা ধ্বনি
ন্যায়ের দাবিতে জেগে
উঠে জনমণি।
কারখানার গেটে লেখা
ইতিহাসের ছায়া
আন্দোলনে গড়া আজকের এই
মায়া।
দুঃসহ দিন পেরিয়ে আজ, গর্বের
১ লা মে
শ্রমিকেরই শক্তি গড়ে
ভবিষ্যতের নেমে।
হাতুড়ি আর হাতের কলে
গড়ে তোলা দেশ
তাদের ন্যায্য দাবিই
হোক আজকের নিঃশেষ।
শ্রম নয় লাঞ্ছনা, হোক
তা মর্যাদার
সকল ঘাম হোক সোনার,
ন্যায়ের সেবাদার।
নয়তো ইতিহাস বলবে, ভুলে
গেছি পথ
যেখানে শ্রমিকের ছিল না
কোনো রথ।
তাই আজ এই দিনে করি
প্রতিজ্ঞা পূর্ণ
শ্রমের মর্যাদা হোক সকল
অধিকারের মূল্য।
১লা মে শুধু উৎসব নয়,
এক ইতিহাস
যেখানে শ্রমিক গড়েছে
বিজয়ের আশ।
আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস
সুমাইয়া ইসলাম
আন্তর্জাতিক
শ্রমিক দিবস
পহেলা
মে আজ
বিশ্বের
মেহনতি মানুষের
মাথায়
জয়ের তাজ।
এই জয়ের
তাজ অর্জন করতে
দিতে
হলো প্রাণ
পহেলা
মে ফিরে এলে
পাই
সেই রক্তের ঘ্রাণ!
১৮৮৬
সাল
মে-এর
প্রথম দিন
শিকাগো
সিটির হে মার্কেটে
বাজলো
যুদ্ধ বীণ।
দাবি
একটাই শ্রমিকগণের
আট
ঘণ্টা দিবে শ্রম
দাবি
আদায়ে সোচ্চার তারা
হবে
না আর ভ্রম।
শ্রমিকের
দাবি মেনে নেয় না
কারখানা
মালিকগণ
তাই
মিছিলে বোমা, গুলি
আর
শ্রমিক শহিদ হন।
এই
ঘটনা কেন্দ্র করে
অনেক
কিছুই ঘটে
কালক্রমে
পহেলা মে
শ্রমিক
দিবস হয়ে ওঠে।
পহেলা
মে-এর সেই ঘটনায়
অন্তরাত্মা
হয়ে ওঠে বিবশ
সেই
ঘটনার স্মরণে আজও
উদযাপিত
শ্রমিক দিবস।
বিশ্বজুড়ে
আজও তাই
পালিত
হয় শ্রমিক দিবস
ইউনেস্কো
এর ঘোষণায় নাম হয়
আন্তর্জাতিক
শ্রমিক দিবস।
শ্রমিকের
গান
বেপারী মো. রাশেদ
নীরব পথে হেঁটে যারা
জীবন টানে কাঁধে করে
ঘামে ভেজা সকাল
বেলা
স্বপ্ন রাখে হৃদয় ভরে।
যাদের শ্রমে রক্তে ঘামে
এই সভ্যতা উঠছে গড়ে
যারা তাদের আপন হাতে
এই পৃথিবী সাজিয়ে ধরে।
উন্নয়নের শিল্পী তারা
উন্নতি নেই নিজের ঘরে
ঝড় বাদলে
মুষলধারে
তাদের নীড়ে জল পড়ে।
দিনের শেষে হারিয়ে যায়
কতো দুঃখ রেখে তাঁরা
এমনি করেই চলছে ভাই
শ্রমিকের এই জীবন ধারা।
ন্যায্যতা
মোঃ আবদুল করিম বেপারী
মে দিবস একদল লোক সৃষ্টি করেছে। সারা বিশ্বের লোক এখন তা পালন করে।
দিনটি ধার্য্য হবার আগের দিনগুলো কত বিরস, কষ্টের কেউ কি তা মনে রেখেছে? নিশ্চয়ই
না। দিনমান কর্মযজ্ঞতায় ক্লান্তি কাটাবার ফুরসৎহীন শ্রমদায়ী মানুষেরা বিত্তবান
অমানুষদের সজ্ঞাহীন অত্যাচারে দিন-রাত শ্রম দিতে দিতে এক দিন শ্রমিক বিদ্রোহ হলো।
ক্লান্ত দেহ রক্তাক্ত হয়ে রাজপথে গড়িয়ে পরল। আর তো সে উঠল না। আজও না, কখনও না।
১৮৮৬ সাল। সিকাগো শহরের হে মার্টেক । শ্রমিক
মালিকের অসম চিৎকার। হাড় ঝিরঝিরে কংকালসার একদল খেটেখওয়া মানুষ আর মহাজনের আজ্ঞাবাহী
বন্দুকদারী রিষ্টপুষ্ট বাহুবলের পাহাড়াদার। উভয়ের দাবী উভয়ের অধিকার। শ্রমিকের
দাবী, আমাকে আমার পাওনা দাও। মহাজনের দাবী, শ্রম দাও, উৎপাদন দাও, বিশ্রাম
বিলাসিতা বাদ দাও। বেতন খোরাকী যা লাগে তা নাও অথবা মহাজন যা দিবে তাতে তুষ্ট হও।
কাজে ফাঁকি দিবে না, শ্লোগান দিবে না। ছুটি পাবে না চিকিৎসা হবে না। মজুরী বৃদ্ধি
হবে না। দিনমান খাটুনী দিবে। তার বাহিরে কোন শব্দ হলে কাজ পাবে না। দ্বিমতের
দানাবাধাবার চেষ্টা করলে হয়তো জীবন থাকবে না।
দেড় শত বছর। জম্ম সার্ধ্যতম বর্ষ। কলমের খোঁচায়
লিখে দিলাম। কিন্তু একবার কি ভেবেছি, রাস্তা আসলে কত দূর? কত সম্রারাজ্য ভেঙে কত
খণ্ডখণ্ড স্বাধীন রাষ্ট্র হলো? কত রাজ পরিবার স্বমূলে বিনাশ হলো? কত রাজন্য প্রজম্ম ভিক্ষা চেয়ে
অন্ন পেল?
যে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের সীমানায় সূর্য অস্তমিত হতো না, এখন তারাই কি তাদের পুরানো
দ্বীপ রাজ্যে সীমাবদ্ধ হলো না? পালতোলা জাহাজের স্থলে, মোটর চালিত জাহাজ হল?
আকাশপথে মালামাল আমদানী রপ্তানি হল? মাথায় মুটো, ভারে বহন, গরু-মহিষ-ঘোড়া-গাধার
গাড়ি, উটের বহন ব্যবস্থা রহিত হল? সবই তো যান্ত্রিক হলো? ডাক হরকরার জায়গা কুরিয়ার
কেড়ে নিল। ডাক পিয়নের কদর হারিয়ে গেল। তদস্থলে ক্ষুদ্র বার্তা, ফেসবুক, অন-লাইনে
জবর দখল করল। সবই তো যান্ত্রিক হল। কিন্তু কদরনীয় মে দিবস কি বদল হলো?
শ্রমিকের ন্যায়সংগত দাবী আদায়ের লক্ষ্যে একত্রি
করণের মাধ্যমে শ্রমিক সংগঠন হলো। ভুবন বিখ্যাত শ্লোগান ‘দুনিয়ার মজদুর, এক
হও, এক হও।’ তাও তো হলো? আর্ন্তজাতিক সম্মামনা পেল। আর্ন্তজাতিক শ্রমিক সংঘ
(আইএলও) তৈরি হলো। দেশে দেশে রাষ্ট্রীয়ভাবে দাপ্তরিক কার্যক্রম চলমান হলো, হতে
থাকল, এখনও হচ্ছে তো? কারখানায়, কারখানায় সংগঠন হল ,তারা অঙ্গসংগঠন তৈরি করল, আবার
সহযোগি সংগঠন দিয়ে পুরো দেশ ছড়িয় দিল। তারপর দাবী আদায়ের শ্লোগানঃ ‘আমাদের দাবী
আমাদের দাবী—মানতে
হবে, মানতে হবে। ১১ দফা, ১১ দফা—মানতে হবে, মেনে নাও। কলকারখানা, কলকারখান—বন্ধ কর, বন্ধ কর। শ্রমিকের
অধিকার—দিতে
হবে, দিতে হবে। আমাদের সংগ্রাম—চলবেই চলবে। রুটি রুজির সংগ্রাম—চলবেই চলবে। শ্রমিক ছাটাইয়ের বাহানা—বন্ধ কর, বন্ধ কর। গাড়ীর চাকা
ঘুড়বে না—অফিস
আদালত খুলবে না। পূঁজিবাদের কালো হাত—ভেঙে দাও, গুড়িয়ে দাও। বরজুয়াদের ষড়যন্ত্র— রুখে দাও, থামিয়ে দাও। শ্রমিক
নির্যাতন, শ্রমিক নির্যাতন—চলবে না, চলবে না। মালিকের দালালেরা—হুশিয়ার সাবধান।
নিজেদের সংগত দাবীসমূহ নিয়মতান্ত্রিক ভাবে না পেয়ে
শ্রমিকরা যখন কারখানার ভিতরে, সামনে, রাজপথে নেমে মিছিলে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার উদাত্ত আহ্বান
জানায় তার অনেক আগে মালিক, পূঁজিবাদী বুর্জোয়া, লুটেরারা শ্রমিকদের প্রতিহত করার
কলাকৌশল এটে নিজেদের বিভিন্ন নামে সংগঠিত হয়ে থাকেন। তাদের নিজস্ব পেটোয়া বাহিনী
মিছিলের উপর অকস্মাৎ বেপরোয়া হয়ে উঠে। কত ঘটন অঘটন ঘটে তার হিসাব কোন পক্ষই কখনও
রাখে না। আইনী ব্যবস্থায় নাজেহালের মোক্ষম হাতিয়ারটাও-তো তাদেরই দখলে থাকে। তারপর
দালাল শ্রেণি এরা শ্রমিকদের ভিতরের লোক। মধ্যস্বত্ব ভোগী ফরিয়ার চরিত্রে তাদের
অভিনয় খুব সুন্দর। এরাই উস্কানিমূলক ক্রিয়া কর্মের দ্বারা বা তারা নিজেরাই
ভাংগচুর, অগ্নিসংযোগ ঘটায়। তারপর থানা পুলিশ, আইনী ব্যবস্হা, মামলা, আদালত মামলার
দীর্ঘ সূত্রিতা, দেন-দরবার, ছাটাই-টার্মিশন, বরখাস্ত ইত্যাদি শ্রমিকদের জীবনকে
অতিষ্ঠিত করে তোলে। অনেক দুঃখজনক ঘটনার সৃষ্টি হয় বিভিন্ন প্রেক্ষাপটে। কিন্তু মজা
হচ্ছে সব সময় মধ্যস্থতাকারী হিসাবে তারাই থাকে যারা সমস্ত অঘটনের জন্য দায়ী।
শক্তিমান কোন শ্রমিক সংগঠন বাংলাদেশের কোন
কল-কারখানা, অফিস আদালতে আছে বলে আমার মনে হয় না। তবে সমঝোতার বশীকরণ ব্যবস্থাপনার
বা লেজুরবৃত্তির সংগঠন প্রায় সব জাগায় থাকতে পারে। একটি প্রতিষ্ঠানে বহু
রেজিস্ট্রার সংগঠন বিরাজমান যা আইনে গ্রহনীয় নয়, কিন্তু আছে। আচ্ছা, বলুন
তো, সবার আর্দশ ও লক্ষ্য শ্রমিক কর্মচারীদের কল্যাণ। অথচ, কল্যাণের আধিক্যতায় পরস্পরের
প্রতি যে পরিমান তুচ্ছ তাচ্ছিল্যের লিলাবতী বাক্য বান চলে তাতে কি কল্যাণের কোন
কথা থাকে? ক্ষুদ্র দূর্বল রাজ্যের রাজা কি রাজা নন? সংগঠন যত ছোট হউক ওখানে
থাকেন কিছু নেতা। নেতা নামের চলতি বাহন সময়ে অসময়ে বহমান থাকার অনেক বড় পদাঙ্ক পদ
নয় কি? দেশে রাজনৈতিক দলের সংখ্যা যত বৃদ্ধি পাবে পালাক্রমে ট্রেডইউনিয়ণ কড়চা
গুনিতকহারে চলবে। ফলে শ্রমিক কর্মচারীদের সংগত দাবী আদায়ের শক্তি ও ক্ষমতা ধীরে
ধীরে হীন হতে হীনতর হতে বাধ্য নয় কি?
শ্রমিকরা শ্রম বিক্রী করে জীবন সংসারের ভোজ্য
উর্পাজন করে স্ত্রী পরিজন নিয়ে চলে। জীবনমান সুন্দর করার লক্ষ্যে উদয় অস্তাচল শ্রম
দিয়ে থাকে। কিন্তু আশানুরূপ সুন্দর তো হই না বরং তাদের নিয়ে সম্মিলিতভাবে ভোজবাজি
খেলা হয়ে থাকে। কোনো কর্মকর্তা কর্মচারী শ্রমিকদের বেশি প্রতারিত করতে মালিক পক্ষ
সেই লোককে অধিক দক্ষ কর্মী বলে মনে করে। লোহার কুঠার দেহে গাছের আছারী লাগিয়ে কাঠ
কাটে। বিষয়টি বিকল্পহীন হলেও ভাবনাটা কিন্তু মন্দ নয়। সেই দাসপ্রথা হতে শ্রমজীবি
মানুষরা আজ পর্যন্ত একই উপায়ে কর্তৃত্ববাদীদের হাতে নিষ্পেষিত হয়ে আসছে।
রাস্তায় রাস্তায় চাঁদাবাজি। নৈরাজ্য। ঘন্টার পর
ঘন্টা জ্যামে বসে থাকা। যানজট। গলিতে গলিতে মিছিল। গাড়ী আগায় না। ফুটপাথ
ফেরিওয়ালাদের আদিতে দখল। আসলে কি তাই? সংকট সৃষ্টি হয়? না সংকট সৃষ্টি করানো
হয়? তা কেউ একবার ভেবেছেন কি? পরিবহনসহ সকল উৎসের চাঁদার টাকা কোথায়
যায়? শ্রমিক কেন অনাহারে থাকে? রাস্তা বন্ধ করে মিছিলের কারণ কি?
ট্রাফিক পুলিশের হ্যান্ডসেক আর যান জটের দীর্ঘতার মাঝে কোন সূত্রতা আছে কি? পর্দার
অন্তরালে জটের কোন শংকরায়ন হয় না তো? ফেরিওয়ালা কারা বসায়, কারা তোলে?
ফেরিওয়ালা কি আসলেই ফেরিওয়ালা? না সামনের বড় দোকানের মালিকের দৈনিক মজুরীর
দেকানদার? ভাবনাটা যদি রাজনৈতিক দ্বারা পরিচালিত জনগনের রাষ্ট্রীয় সরকার ভাবেন তা
হলে মে দিবসের স্বার্থকতার মূল দর্শনের সূত্রায়নের সেতু বন্ধন খুঁজে পাওয়া যেতেও
পারে।
আজ প্রতিদিনই মে দিবস। নৌ-পথ, রেল পথ, আকাশ পথ, সড়ক
পথ, কল কারখানা, মার্টেক, গার্মেন্টস, কোথায় নেই শ্রমিক নির্যাতন? দৈনিক মজুরীতে
গতর খাটিয়ে শ্রম বিক্রী তারা কি শ্রমের মূল্যটা ঠিকমত পান? রেমিট্যান্স যোদ্ধারা
পরিবারের স্বচ্ছলতা ও দেশের উন্নয়ণের জন্য স্ত্রী পূত্র সন্তান, আত্মীয়স্বজন রেখে
হাজার হাজার মাইল দূরে ভিন দেশের অবকাঠামোগত উন্নয়নে অহরাত্রি শ্রম দেন। সেই
তারাই তো বিমান বন্দরে এসে সব খুইয়ে কেঁদে কেঁদে, অপমানিত হয়ে, ব্যথিত বক্ষে,
শূণ্যহাতে বাহিরে এসে দাঁড়ান। এবার বলুন তো আপনি এতো বছরে কি আপনার শ্রমের
ন্যায্যতা পেয়েছেন কি?
যত দিন পর্যন্ত সভ্য পৃথিবী টিকে থাকবে, তত
দিন পর্যন্ত আনুষ্ঠানিকভাবে মে দিবসের অলংকরণ বলবৎ থাকবে হয়তো। কিন্তু মে দিবসের
মূল আবেদন আগামী বছরগুলোতেও বাস্তবায়ন ক্রিয়ায় সমুন্নত হবে কি না সে সন্দেহ থেকেই
যায়।