বাবা দিবস বিশেষ সংখ্যা ২০২৫

বাবা দিবস বিশেষ সংখ্যা ২০২৫

গোগলের ওভারকোট আর আমার বাবার কালো কোট

রা জু  আ লা উ দ্দি ন

পরিবারের প্রয়াত কাউকে নিয়েই প্রকাশ্যে লিখতে আমার সংকোচ। মনে হয় বাবা মা আমাদের ব্যক্তিগত, যদি না তারা কোনো কারণে বিখ্যাত ব্যক্তিত্ব না হয়ে থাকেন। আমার বাবা মা বিখ্যাত কেউ ছিলেন না। সুতরাং তাদের প্রয়াণ মানে আমার ব্যক্তিগত লোকসান, এদিয়ে কাউকে বিষণ্ণ করার অধিকার আমার নেই। ঠিক এ কারণে আমার বাবা এবং মায়ের প্রয়াণের সংবাদ আমি জানাতে সাহস করিনি প্রকাশ্যে। কী হবে এসব জানিয়ে! তবে বাবার মৃত্যুর পর তাকে নিয়ে একটি স্মৃতিচারণ করেছিলাম একবার। সেটাই আজ পিতৃদিবসে পুনর্পাঠ করতে ইচ্ছে হলো। অন্যদেরকেও পড়ার আমন্ত্রণ জানাই স্রেফ লেখাটির জন্যই, সমবেদনার প্রত্যাশায় নয়। লেখাটি নিচে দেয়া হলো:

‘আমার বয়স তখন ১১ কি ১২, কিংবা আরেকটু কমও হতে পারে। বয়স আর সাল তারিখের ব্যাপারটা আমি একেবারেই ঠিকঠাক মনে করতে পারি না। এবং এই না-পারার কারণে আমি চিরন্তনের বোধ থেকে এক ধরনের সান্ত্বনা খুঁজে ফিরি উটপাখীর মতো, অর্থাৎ আমি চাই বা না চাই, সাল তারিখতো আছেই, চোখ বুজে অক্ষমতা প্রকাশ করলেও তা গুরুত্বহীন হয়ে পড়ে না। আমি ওরকমই। যাইহোক, সাল আর বয়স বোধের ব্যাপারে আমার অজ্ঞতা মার্জনা করলে ঘটনাটা এভাবে বলতে পারি: আমার বাবার সঙ্গে ঢাকা থেকে গ্রামের বাড়ি যাচ্ছিলাম। শীতকাল, আমার খুবই প্রিয় এক ঋতু। কিন্তু শীত তখনও খুব জেঁকে বসেনি। ঢাকায় অন্তত তেমনটা টের পাওয়া যাচ্ছিল না সে-বার। সে যুগে বাবা খুব সৌখিন ছিলেন, তখন তিনি যৌবনের তুঙ্গ অবস্থানে। আমি জানি সৌখিনতা ব্যাপারটা তিনি পারিবারিক ঐতিহ্য থেকে পাননি, সেটা সম্ভবও ছিল না, কারণ তিনি জন্মেছিলেন গ্রামের এক গরীব পরিবারে। তবে কীভাবে যেন তিনি যুক্ত হয়েছিলেন সে-যুগে আমাদের এলাকার এক বনেদি ধনাঢ্য পরিবারে। সেখান থেকেই তিনি পেয়েছিলেন রুচির এক আভিজাত্য। পোষাকে সেই আভিজাত্যের ছাপ ছিল। কিন্তু ছাপটা দীর্ঘস্থায়ী ছিল না। ওই বনেদি পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার পর তিনি কণ্টকিত ও অনভিজাত এক বাস্তবতার মুখোমুখি হওয়ার ফলে বহিরঙ্গে বদলে গিয়েছিলেন। কিন্তু পোষাক যত দ্রুত বদলানো যায়, খাসলত অত সহজে নয়। ফলে আমার বাবা গোটা গ্রামে দর্শনীয় ও আলোচিত ব্যক্তি হিসেবে পরিচিত ছিলেন। আরও পরিণত বয়সে যখন বাবা সৌখিন শার্ট-প্যান্ট এবং কোট পরা ছেড়ে একেবারে সাধারণ পোষাকআষাক পরতে শুরু করেছেন, তখন বাবার ব্যবহৃত পুরোনো সেসব জামাকাপড় আমার মা যত্ন করে রেখে দিয়েছিলেন। ওভাবে রেখে দেয়ার ফলে হয়েছে কি, আমি যখন ওই পোষাকগুলো পরার মতো শারীরিক আয়তন অর্জন করেছি, তখন কৌতূহল বোধ থেকে তার দু’একটা পরেওছিলাম। সেগুলো আমার কালে এসে অতটা ফ্যাশনেবল ছিল না ঠিকই কিন্তু ওগুলো পরার মধ্য দিয়ে অনুভব করতাম আমি বড় হয়ে গেছি বাবার মতো, বয়স তখন সম্ভবত ১৭/১৮। কিন্তু আমি যে সময়টির কথা বলতে চাইছি, ওই ১১/১২ বছর বয়সে, তখন পোষাক বিষয়ে আমার কোনো আগ্রহ বা সচেতনতা তৈরিই হয়নি। হওয়ার কথাও নয়। কিন্তু তবু বাবার একটি পোষাক আমার হৃদয়কে দ্রবীভূত করে রেখেছে এই পরিণত বয়সেও।


সেকালে লঞ্চে করে আমাদের গ্রামের বাড়িতে আসা ছাড়া অন্য কোনো বাহন ছিল না। সম্ভবত বিকেলে সদরঘাট থেকে লঞ্চে উঠে সুরেশ্বর ঘাটে নেমেছিলাম রাতের দিকে, রাত নটার দিকে হবে হয়তো। সেই সময় সুরেশ্বর থেকে পাঁচ ছ’ মাইল পায়ে হেঁটে বাড়ি পৌঁছুতে হতো। তখন তো আজকের মতো রিকশা চলাচলের কোনো ব্যবস্থা ছিল না। সুরেশ্বর নেমে পায়ে হেঁটে যাচ্ছিলাম আমরা বাপ বেটা। বাবা পথ সংক্ষিপ্ত করার জন্য পন্ডিতসার থেকে একটা বিলের উপর দিয়ে আড়াআড়ি পথ ধরার সিদ্ধান্ত নিলেন। শীতের রাত, তার উপরে গ্রামের সেই গা ছমছমে অন্ধকার, কিন্তু আমার কিংবা বাবার মধ্যে এই অন্ধকার নিয়ে কোনো ভীতি ছিল না। আমার তো নয়ই, বাবার সঙ্গে থাকলে কোনো সন্তানেরই ভয় থাকে না
বাবা এমনই এক নিরাপত্তা। অসংখ্য ঝি-ঝি পোকা আর জোনাকির আলো ও শব্দের সুতোয় বোনা রাত্রির কালো বস্ত্র ভেদ করে বাবার হাত ধরে আমি হেঁটে চলছি। আকাশে চাঁদ নেই, কিন্তু জীবিত ও মৃত সব নক্ষত্রের সম্মিলিত আলোর এক ধূসর আভায় ক্ষেতের আইলগুলো দেখা যাচ্ছিল বলে হাঁটতে কোন অসুবিধা হচ্ছিল না। আমার গায়ে হাল্কা গরম পোষাক থাকলেও এই উন্মুক্ত প্রান্তরে অবারিত আশ্রয় পেয়ে শীত যেন প্রগাঢ় হয়ে উঠেছিল। আমার খুব ঠান্ডা লাগছিল। বাবাকে বললাম, ‘আমার শীত করছে খুব’। বাবা, একটুও চিন্তা না করে সঙ্গে সঙ্গে তার গায়ের কালো কোটটি আমার গায়ে চড়িয়ে দিয়ে শুধু বললেন, ‘আর শীত করবে না, বাবা।’ সত্যি আমার আর শীত করছিল না। কিন্তু বাবার? তার কি শীত করছে না? না, নিশ্চিতভাবেই আমার মাথায় তখন এসব প্রশ্ন ছিল না, ওই বয়সে কারোরই থাকে না। তবুও বাবাও তো আমার মতোই রক্ত মাংসেরই মানুষ। তিনি কীভাবে শীতকে উপেক্ষা করেছিলেন? সন্তানের প্রতি ভালোবাসা ও কর্তব্যবোধের অদৃশ্য চাদর কি তাকে উষ্ণ করে তুলেছিল? জানি না কী ঘটেছিল। শুধু জানি পরিণত বয়সে এই স্মৃতি আমাকে এমন এক উষ্ণতায় ভরিয়ে দিয়েছে যে এখনও সেই স্মৃতি মনে করলে হৃদয় আর্দ্র হয়ে ওঠে।


বলা হয়ে থাকে এবং তা সত্যিও: আধুনিক রূশ সাহিত্য বেরিয়ে এসেছে গোগলের ‘ওভারকোট’ থেকে। আমি বেরিয়ে এসেছি আমার বাবার কালো কোট থেকে। আর ওইটুকু ছোট্ট শরীরে ওটা ছিল গোগল-বর্ণিত ওভারকোটের মতোই বড়। বাবা এখন শীত গ্রীষ্ম নির্ভেদে এক সাদা বস্ত্রে একাকী আছেন। বাবা বিলের সেই অন্ধকার ও শীত নিয়ে গেছেন সঙ্গে করে যাতে করে আমাকে কষ্ট পেতে না হয়। কিন্তু তিনি কোটটা নিয়ে যাননি সঙ্গে করে, ওটা তিনি আমার জন্য রেখে গেছেন। আমি ওই কোটটা আমার সন্তানকে দেবো যদি ওদের প্রয়োজন হয়।

 

আমার বাবা, আমার ঈশ্বর!

দ য়া ম য়  পো দ্দা র

আমি একটি ছিন্নমূল পরিবারের বড় ছেলে। এরকম পরিবারে কোন গল্প থাকে না, কোন স্বপ্ন থাকে না। রূঢ় বাস্তবের মাটিতে গল্প অথবা স্বপ্ন জন্ম নিতে নিতেই মরে যায়। কিন্তু আমার বাবা সেই অপ্রাপ্তির জায়গাটিকে বুঝতে না দেবার জন্য প্রণিপাত চেষ্টা করেছেন। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বধীনতা যুদ্ধের সময় অনেক পরিবারের মতো আমাদের পরিবারও শরণার্থী হয়ে ভারতে আশ্রয় নিয়েছিল। তৎকালীন ভারত সরকার শরণার্থীদের জন্য অনেক সুযোগ সুবিধাসহ পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করেছিল, কিন্তু আমার পরিবার তখন থাকেনি। শস্য-শ্যামল সোনার বাংলায়, জন্মভূমিতে ফিরে গিয়েছিল। তবে বেশি দিন স্থায়ী হয়নি। ধীরে ধীরে বাংলাদেশের চরিত্র বদলাতে থাকে। তাই পুনরায় দেশ ছাড়তে বাধ্য হয়। এবং সেটা প্রায় কর্পদক-শূন্য অবস্থায়। ততদিনে ভারতের চরিত্রও বদলে গেছে অনেকখানি। পশ্চিমবঙ্গে বামফ্রন্ট সরকার, যারা বাংলাদেশ থেকে আসা শরণার্থীদের সঙ্গে এক ঘৃণ্য রাজনীতির খেলা খেলতে শুরু করে। অসহায়, ভিটেমাটি হারা মানুষগুলোকে এককথায় গোলাম বানিয়ে রাখার রাজনীতি ছিল সেটা। আমার শৌখিন পিতা এবং সহজ-সরল পিতার শুরু হয় এক অসম জীবন-যুদ্ধ। তখন বড় হচ্ছি আর প্রতিদিন দেখছি একজন পিতা একটু একটু করে নির্বাক, সর্বংস্বহা হয়ে যাচ্ছেন। কি অপরিসীম কঠোর পরিশ্রম করছেন একটি পরিবারের মুখে একমুঠো ভাত তুলে দেবার জন্য। বৃষ্টি, বজ্র-বিদ্যুৎ কিংবা অস্বাভাবিক গরম, সব ঋতুতেই বাবার অনুভূতি জমা হত কর্তব্য শব্দে। কাজ বন্ধ করার উপায় নেই, তাই বাবার শরীর খারাপও হয় না। এক একদিন ইস্কুল থেকে বাড়ি ফিরে দেখতাম বাবা বারান্দার মাটিতে শুয়ে আছে, আর মাটি ঘামে ভিজে গেছে। বাবা ডাকতেন, পিঠের উপরে দাঁড়িয়ে শরীরটাকে একটু মাড়িয়ে দিতে। হাটবারে বাজারে যেতাম বাবার সঙ্গে জিজ্ঞেস করতেন কি মাছ নেব।  দেখতাম ডালায় কত রকমের মাছ সাজানো দোকানে দোকানে।  ইতস্তুত করতাম, ভয় হতযদি বাবার কাছে টাকা না থাকে, কিংবা বাজেটে না কুলোয়। ঠিক একইরকম হত সব্জি দোকান, ফলের দোকান অথবা মিষ্টির দোকানের সামনে গিয়ে। কিন্তু বাবা ঠিক মন বুঝতেন, তাই যেটা ইচ্ছে করত, দেখতাম বাবা সেই জিনিসটাই কিনেছেন। তবে বেশিরভাগ দিনই কিনতে পারতেন না আর্থিক সীমাবদ্ধতায়। তখন বাবার মুখটা অব্যক্ত বেদনায় ভরে উঠত। এমন হয়েছেবাবা মিষ্টির দোকানে বসিয়ে দিয়ে দোকানদারকে দুটি রসগোল্লা একটি পাউরুটি দিতে বলে বাইরে দাঁড়িয়ে আছেন।  চার ভাই, বাবা মা একজন পঙ্গু কাকা নিয়ে আমাদের পরিবার। কিন্তু শত সমস্যা থাকা সত্ত্বেও এমন দিন খুব কম গেছে যে খাবার সময় বাইরের কোন লোক খায়নি বা না খেয়ে ফিরে গেছে। সেই পরিবারের বড় ছেলে বাউন্ডুলে কবি। এইতো সেদিনও বাবা কোথাও মতুয়া সম্মেলনে গিয়েছেন, সেখানে একটা লোকের সঙ্গে দেখা, পরিচয়ে জানতে পেরেছেন তিনিও একটু-আধটু কবিতা লেখেন। বাবা তাঁকে ধরে বাড়ি নিয়ে এসেছেন, দুপুরে উপস্থিতমতে দুটো খেতে দিয়েছেন। হয়ত সেই অপরিচিত মানুষটির মধ্যে বাবা তাঁর বাউন্ডুলে কবি ছেলেটিকে দেখতে পান। তবে বাবা খুব কম গায়ে হাত দিয়ে শাসন করেছেন। শুধু চোখ রাগিয়ে দুটো বকা দিলেই  আজও পৃথিবীটা আঁধার লাগে, খাওয়া বন্ধ হয়ে যায়। আজও বাবা সবার আগে ঘুম থেকে ওঠেন, জমির আলে এক চক্কর ঘুরে আসেন। আমি আজ আমি হতে পেরেছি বাবার জন্য। হাজার বছর বেঁচে থাকুক আমার বাবা, আমার ঈশ্বর!


আমার বাবা

মোঃ ম জি ব র  র হ মা ন

আমার বাবা আবদুর রহমান ওরফে রহম আলী মাষ্টারের জন্ম শরীয়তপুর জেলার ডামুড্যা উপজেলার কাইলারা গ্রাম। বাবার নাম ইউসুফ আলি মাদবর। আমার অশিক্ষিত দাদা-দাদী বাবার জন্মের সন, তারিখ লিখে রাখেন নি। তখন তার দরকার ও হয়নি।


খুব অল্প বয়সে বাবা তার বাবা মাকে হারিয়ে এতীম হন। তার বড় বোনের আশ্রয়ে তিনি বড় হয়েছেন। নিম্নবিত্ত ঘরে বাবা-মা হারা একটি সন্তানের অবস্হা সহজেই অনুমেয়। তবু নিজের অদম্য ইচ্ছায় তিনি পড়াশুনা চালিয়ে গেছেন। ম্যাট্রিক পর্যন্ত পড়তে সক্ষম হননি আর্থিক সমস্যার কারনে। সে সময় ম্যাট্রিক পরীক্ষা পাশ না করেও জি, টি (গুরু ট্রেনিং) পাশ করে প্রাইমারী শিক্ষক হওয়া যেত। আমার বাবা চাঁদপুরের বাবুর হাট থেকে জি, টি পাশ করে শিক্ষকতা পেশায় যোগদান করেন, হলেন মানুষ গড়ার কারিগর। শিক্ষায় অনগ্রসর জাতির জন্য তা অত্যাবশ্যকও ছিল। প্রাইমারী শিক্ষক হিসাবে তিনি অনেক স্কুলে শিক্ষকতা করেছেন। তার শিক্ষকতা শুরু হয় উত্তর সিড্যা প্রাইমারী স্কুল দিয়ে (পতাই খার স্কুল নামেও এর পরিচিতি আছে)। পরবর্তীতে মধ্যসিড্যা প্রাইমারী স্কুল, নান্দ্রা মডেল প্রাইমারী স্কুল, চরকুমারিয়া প্রাইমারী স্কুল (সাদিমালী হাওলাদারের বাড়ী সংলগ্ন) ও ছয়গাও খলিল মেমোরিয়াল প্রাইমারী স্কুল উল্লেখযোগ্য। ১৯৭৩ সালে ভেদরগঞ্জ থানার ছয়গাও খলিল মেমোরিয়াল প্রাইমারী স্কুল হতে তিনি অবসর গ্রহন করেন। তিনি বিভিন্ন ক্লাসে অংক, সমাজ ও ধর্ম পড়াতেন। তার পড়ানোর মধ্যে গভীর মনোযোগ ও আন্তরিকতা থাকতো। স্কুল শুরু হবার আগেই তিনি স্কুলে পৌছতেন এবং স্কুল ছুটির পর বাড়ি ছুটতেন। জীবনে তিনি খুব কমই ছুটি ভোগ করেছেন। পাওনা ছুটিও তিনি সাধারনত ভোগ করতেন না। সাধারনভাবে সে সময় শিক্ষকদের মধ্যে নিয়মানুবর্তিতা, আদর্শবাদিতা, ছাত্রদের প্রতি মমত্ববোধ ও দায়িত্ববোধ বর্তমান সময়ের তুলনায় বেশি ছিল। বর্তমান সময়ের মতো অর্থনির্ভর হয়ে উঠেনি। সে সময় শিক্ষকরা আদর্শ নিয়ে চলতেন। আমার বাবা ছিলেন আদর্শ শিক্ষকের একটি উদাহরণ। আমার বাবা ছিলেন আমাদের কৃষিনির্ভর এ ছোট গ্রামের প্রথম চাকুরীজীবি।


১৯৬০ সালে ৬ বছর বয়সে আমি নান্দ্রা মডেল প্রাইমারী স্কুলে ওয়ানে ভর্তি হই। বাবা তখন ঐ স্কুলের একজন সহকারী শিক্ষক। বাবা এ স্কুলের শিক্ষক হবার সুবাদে আমি নিকটস্থ পূর্ব সিড্যা প্রাইমারী স্কুল (কাইলারা স্কুল) এ পড়াশুনা না-করে অপেক্ষাকৃত দূরবর্তী নান্দ্রা মডল প্রাইমারী স্কুলে ভর্তি হই। এসময় হেড মাষ্টার ছিলেন খন্দকার খলিলুর রহমান। অনান্যদের মধ্যে আফসারউদ্দিন স্যার, মহিউদ্দিন স্যার, ইছমাইল মৌলবী, লোকমান স্যার প্রমূখ। সে সময় দশমিক মুদ্রা চালু হয় নাই। এক পয়সা, দুই পয়সা, একআনা, দুই আনা, চার আনা, আটআনা, এক টাকার ধাতব মুদ্রা চালু ছিল। বাবার কাছ থেকে নিয়ে দুই পয়সার বুট, এক আনার চিনাবাদাম বা আইস ক্রিম কিনে খেয়েছি সে দিনগুলির কথা মনে পড়ে। এক পয়সা দিয়ে কিছু কিনে খাওয়া যেত। তখন নান্দ্রামডেল প্রাই মারী স্কুল, দারুল আমান হাই স্কুল, বাজার, পোষ্ট অফিস, কৃষি গোডাউন ও খেলার মাঠ নিয়ে দারুল আমানের রমরমা অবস্হা এবং এর প্রাণপুরুষ ছিলেন আ কা মোঃ আবদুল গনি মাষ্টার। বাবা ছিলেন একজন সফল শিক্ষক। তার অনেক ছাত্র ব্যক্তিজীবনে ও সমাজ জীবনে প্রতিষ্ঠা লাভ করেছেন। তারা যখন বাবার নির্মোহ জীবন আর শিক্ষক হিসাবে তার সুনামের কথা বলেন তখন তার ছেলে হিসাবে আনন্দ অনুভব করি। বাবা ছিলেন খুবই সাদাসিধা ও ধর্মপ্রান ব্যক্তি। মহাগ্রন্হ কোর আন সম্পর্কে তার ধারণাও ছিল ভাল। যেখানেই যেতেন প্রায় যায়গাতেই তাকে নামাজে ইমামতি করতে হতো। রমজান মাসে তিনি তারাবী পড়াতেন। নামাজে ইমামতির সময় তিনি কোরআন শরীফের ৩০ পাড়ার সুরা ছাড়াও তিনি
সূরা বাকারার ১৫২-১৫৮ আয়াত; সূরা বাকারার ২৫৪-২৫৫ আয়াত; সূরা বাকারার শেষ ৩ আয়াত; সূরা তওবার শেষ ২ আয়াত; সূরা আল এমরানের ২৬-২৭ আয়াত; সূরা কাহাফের শেষ ২ আয়াত; সূরা মুলকের ১ম কয় আয়াত; সূরা ইয়াসিনের ১ম কয়েক আয়াত; সূরা হাসরের শেষ ৩ আয়াত; সূরা আর রহমানের ১ম কয়েক আয়াত বেশী পড়তেন। শুনতে শুনতে আমিও এর কয়েকটি আয়াত মুখস্থ করে ফেলি।


আমার বাবা কায়ক্লেশেই সংসার চালিয়েছেন। পিতৃ-প্রদত্ত কানি দুই জমি আর তা বেতন ছিল আয়ের উৎস। সীমিত সামর্থের মধ্যেই তিনি আমার মা, ০৪ ভাই, ০৩ বোনের সংসার সামলিয়েছেন। তিনি যেমন সমাজকে শিক্ষার আলো দিতে চেষ্টা করেছেন তেমনি নিজের ছেলে-মেয়েদেরকে শিক্ষিত করার চেষ্টা করেছেন। তার আদর্শে অনুপ্রানিত হয়ে আমাদের এক ভাই আবদুল গফুর শিক্ষকতাকে পেশা হিসাবে নিয়েছিলেন। সংসারটিকে তিনি বটবৃক্ষের ছায়া দিয়েছেন, ছাতার মতো আগলে রেখেছেন, আমাদেরকে দারুন মমতায় মানুষ করেছেন। ১৯৭৯ সালের ২৬ শে জুলাই, ১৩৮৬ সালের ৯ ই শ্রাবণ, ১লা রমজান তিনি ইন্তেকাল করেন।


বেশ ক’ বছর আগে বাবা মারা গিয়েছেন। আমরাও এখন দাদা, নানা হয়ে গেছি। ইতোমধ্যে আমাদের ০১ বোন ও ০১ ভাই ইন্তেকাল করেছেন। এখনো বাবার স্মৃতি মনের কোনে ভেসে উঠে। তার সাথে আরও একজনের ছবি ভেসে উঠে তিনি আমার মা যিনি আমাদের জন্য প্রসবযন্ত্রণা সয়েছেন, পরম যত্নে আমাদের মানুষ করেছেন এবং আমার বাবার সংসার সামলিয়েছেন। মহান আল্লার কাছে তাঁদের জন্য আমাদের প্রার্থনা
‘রাব্বির হামহুমা কামা রব্বা ইয়া নি সাগিরা’ (আল্লাহ তাদের তুমি রহম করো যেরূপ তারা শৈশবকালে লালন পালন করেছেন)।


নায়ক কে? বাবা না আমি?

খা ন  ন জ রু ল  ই স লা ম

বাবা বললেন আয়, আমার সাথে আয়। কোথায়? কেনো? এসব প্রশ্ন করার সাহস আমাদের ছিলো না। আমি বাবার পিছু পিছু হাটলাম। বাবা আমাকে ধরিয়ে দিলেন চারটি ধনচে। বিলের পুকুরের পারে গিয়ে বাবা পকেট থেকে বড়শি লাগানো সুতা বাঁধলেন ধনচায়। পাশের ছোট খালে মাছধরুয়া কয়েকজন থেকে কিছু গুতম মাছ চেয়ে নিলেন। বড়শিতে গেথে চারটি বড়শি কিছুটা দূরে দূরে গেড়ে দিলেন। এপাশ থেকে ও পাশে না যেতেই বিশাল বিশাল শোল মাছ। আট নয়টি মাছ ধরে বীরের বেশে বাড়ি ফিরলাম। বাবার কৃতিত্বে আমি নায়ক বনে গেলাম।


স্কুল থেকে বাড়ি যাচ্ছি, আমাদের রায়েত বাড়ির কাছে আসতেই নজরে পড়লো বাবার মাথায় বোঝা। আমি বিস্মিত, হতভম্ব এবং আহত হলাম। দৌড়ে গিয়ে জোর করেই নিজের মাথায় নিলাম। ‘না তুই পারবি না’ বলে বাবা নিতে চাইলেন। আমি দিলাম না। চাল ফুঁড়িয়ে গেছে। আমাদের মেনেজার ইউনুস মামা দূরে কোথাও গিয়েছেন। মায়ের অতি চাপে নিজেই ধান ভাঙতে তিনি যাচ্ছিলেন। বাবা আমার বই নিয়ে বাড়ি গেলেন। একটু পরে আমি ধান ভেঙে বাড়ি গেলে সবাই বাহাবা দিলেন। বাবার জন্য আমি দ্বিতীয়বার নায়ক হলাম, যদিও ঘারে ব্যাথা নিয়ে এক সপ্তাহ বাড়িতে থাকতে হয়েছে। ক্লাস নাইন বা টেনে পড়ি। স্কুল ছুটি বা লেইজরের সময় শুনলাম বাবা অসুস্থ হয়ে একটি দোকানে অবস্থান করছে। চাচাতো বোন বিউটি বুজির হাতে বই বুঝিয়ে দিয়ে দৌড়ে গেলাম। বাজারের কিছু লোক বাবার মাথায় পানি ঢালছে। আমি গিয়ে জড়িয়ে ধরলাম। চিৎকার দিয়ে বাজার মাথায় তুলছি। আমার সাথে কিছু বন্ধু ও বাড়ির ছেলে মেয়ে ছিলো। আমার অস্থিরতা দেখে দৌড়ে এলেন ডাক্তার জয়নাল আবেদীন। তিনি একটা ঔষধ খাইয়ে এবং একটা ইঞ্জেকশন দিলেন। বাবা শারীরিক সুস্থ হলেন ততক্ষণে বাড়িতে খবর পৌঁছে গেলো এবং বাড়ি থেকে লোকজন দৌড়ে আসতে লাগলো। আমি আাবাকে জড়িয়ে বীরের মতো বাড়ি ফিরলাম। সেদিন মনে হলো আমিই একজন বড়ো ডাক্তার এবং নায়ক।


বাবা কখনো আমাদের হাতে টাকা দিতেন না। একদিন বললেন তোমার চুলগুলো বড় হয়েছে যাও চুল কেটে আসো। আমি ভাবলাম টাকা দেবে না টাকা দেয়নি। বললো ঐ দোকানে গিয়ে চুল ছেটে এসো। আমি এসেই টাকা দেবো। সেলুনে গিয়ে বসতেই তিনি চিনে ফেললেন মনে হয় বাবা আগেই তাকে বলে রেখেছেন। আমি তাকে বপ কাটিং দিতে বললাম তিনি তাই করলেন। আমাকে সে টাকা পয়সার কথা কিছু বললেন না। আমার বন্ধুরা কাটিংয়ের প্রশংসা করলেন আমি নায়কেরবেশে বাড়ি যাচ্ছি। পথিমধ্যে বাবার সাথে দেখা তিনি কিছু বললেন না। শুধু বললেন আমার সাথে আয়। আবার তার পিছুপিছু বাজারের উদ্দেশ্যে হাঁটলাম। ভাবলাম হয়তো কিছু খাওয়ানোর জন্য ডাকছেন। বাবা সোজা সেলুনে গিয়ে আমাকে আবার বসিয়ে দিলেন এবং নতুনভাবে আর্মি কাটিং দিয়ে আমাকে মিষ্টির দোকানে বসিয়ে এক গ্লাস দুধ ও পাউরুটি খইয়ে বাড়িতে পাঠালেন। আমার সেদিন খুব অপমান লাগছিলো। দু-এক ফোঁটা অশ্রুও সেদিন গড়িয়ে পড়েছিল কপল বেয়ে। সেদিন মনে হয়েছিল আমি নায়ক হতে পারিনি। নায়ক আমার বাবা। সত্যিকারের নায়ক।

আজ আমি নিজেও একজন বাবা তবে নায়ক হতে কী পেরেছি? সে ঘোষণা আমার মতো আমার সন্তানরাই দেবেন। প্রতিটি বাবার সন্তারাই দেবেন।


স্মৃতির পাতায় আমার বাবা

ই ব্রা হি ম  খ লি ল

আমার অশিক্ষিত বাবার জন্ম তারিখ সঙ্গত কারণেই আমার জানা সম্ভব হয়ে ওঠেনি, তার কারণ আমার দাদাও ছিলেন একজন অশিক্ষিত মানুষ। বাবা ছেলে দুজনেই অশিক্ষিত ছিলো তার মানে এই নয় যে তারা মূর্খ ছিলেন। তারা সামাজিক শিক্ষায় শিক্ষিত ছিলেন এবং জ্ঞানী ও কঠোর পরিশ্রমী মানুষ ছিলেন।

 

আমার দাদার তিন ছেলের মধ্যে আমার বাবা একজন অতি সাধারণ দিনমজুর কৃষক শ্রেণির মানুষ ছিলেন। অন্যের খেত-খামারে দিনমজুর করাই ছিলো তার আয় উপার্জনের প্রধান উৎস। তাছাড়া তিনি বর্ষা এলেই মাছ শিকার করতেন বিভিন্ন উপায়ে। যা বিক্রি করে সংসার চলে যেতো অনায়াসেই। ছয় ঋতুর কোনো ঋতুতেই তিনি বসে বসে অলস সময় পার করেননি কখনোই। কোন না কোন কাজ তিনি জোগার করেই ফেলতেন যে কোন উপায়ে। আর সম্ভবত এ কারণেই আমাদের পরিবারে অভাব নামক কোন শব্দ ছিলো না বাবা বেঁচে থাকাকালীন সময়ে। তিনি তার নিজের গায়ে আচড় লাগতে দিতেন কিন্তু সংসারের গায়ে অভাবের আচড় লাগতে দিতেন না। তার ফল স্বরুপ বর্ষার সময়ে যখন মানুষের অভাব অনটন বেড়ে যেতো ঠিক সেই সময়ে আমাদের মাটির কলস ভর্তি চাল থাকতো। বাবা বেঁচে থাকতে দু মুঠো ভাতের যে কোনো অভাব ছিলো না তা আমি বড় হয়ে গ্রামের প্রবীণদের কাছেই শুনেছি, যারা আমার বাবার সাথে চলতো ফিরতো কাজ করতো অর্থাৎ যারা ছিলেন আমার বাবার বন্ধু গোছের মানুষজন।

 

যতোটুকু মনে পড়ে আমি ছোট বেলায় আমার বাবাকে খুব একটা পছন্দ করতাম না তার ধুমপান করার অভ্যেস থাকার কারণে। কিন্তু সে যে আমাকে প্রচণ্ডরকম ভালোবাসতেন সেটা আমি বুঝতে পারতাম। খালে বর্ষার পানি এলে আমার বাবা আমাকে খালের পানিতে নিজহাতে গোসল করিয়ে দিতেন। তিনি যখন আমার মুখমন্ডল তার গামছা দিয়ে ডলে দিতেন তখন তার গামছা এবং হাত থেকে বিড়ির উৎকট গন্ধ আমাকে অসস্তিতে ফেলতো। আমার সাত আট বছরের কাঁচা মগজে তখন হয়তো আমার প্রতি আমার বাবার স্নেহ ভালোবাসার যে গভীরতা সেটা বুঝতে পারতাম না। আজ এতোগুলো বছর শেষে আমি নিজেও যখন বাবা হয়ে গেছি ঠিক তখন আমার বাবার সেই ভালোবাসা খুব পেতে ইচ্ছে করে। তার সেই বিড়ির গন্ধ মাখা হাতকে এখন ভীষণ মনে পড়ে। কতো আদরের ছিলো তার সেই হাত, কত ভরসার ছিলো তার সেই হাত, কত নির্ভরতার ছিলো তার সেই হাত, কতটা ছায়াবৃক্ষের মতো আগলে রাখতো আমাকে তার সেই হাত, আজ তা গভীরভাবে অনুভব করি। আজ এতোগুলো বছর পরে মনে হয়না করতেন তিনি আয় রোজগার, না কিনে দিতেন আমাদেরকে নতুন জামা কাপড়, না নিয়ে যেতেন বৈশাখি মেলায়; কেবল তিনি বেঁচে থাকতেন আমাদের মাঝে তাতেই আমি ধন্য হতাম এটা ভেবে যে আমার মাথার উপরে একটা ছাদ আছে। আমাকে আগলে রাখার মতো একটা বিশাল আকাশের মতো প্রসস্ত বুক আছে, যেখানে আমার সকল দুঃখের সাতকাহন লুকাতে পারতাম। নিচে দেয়া ছড়াটি পড়লেই খুব সহজেই যে কেউ  আমার বাবা সম্পর্কে চমৎকার একটা ধারণা পাবেন:

বাবা
খুব সকালে জেগে বাবা পান্তা খেতো রোজ
মরিচ পোড়া পানি ভাতেই প্রতিদিনের ভোজ।
নুন মরিচের সাদা ভাতেই কাটতো বাবার দিন
কারো কাছেই এই মানুষটা নেয়নি কোনো ঋণ।

শক্ত হাতে আয় করেছে ঘাম ঝরিয়ে গায়ের
নেয়নি হাতে চারশ টাকা নোলক বেঁচা মায়ের।
কাজ থামায়নি যতোই ছিলো বাবার গায়ে জ্বর
নিজেই ছানি দিতেন তিনি ছোট্ট ছনের ঘর।

বৃষ্টি ভিজে রোদে পুড়ে একলা করে আয়
ন্যায়ের পথে অটল ছিলো যায়নি ডানে বায়।
খুব সাধারণ জীবন-যাপন খড়কুটোতেই বাস
বাবার জীবন তেমন ছিলো যেমন সবুজ ঘাস।

স্বল্প আয়ের গল্প নিয়ে একলা লড়াই তার
জুলুমবাজি পাপের কাছে নোয়নি বাবার ঘাড়।
যেইটুকু আয় নিজের ছিলো তা দিয়ে তার চলা
কারো সাথে হয়নি বাবার কটু কথা বলা।

নামাজ পড়ে মোনাজাতে তুলতো দুহাত জানি
সেই সময়ে বাবার চোখে ঝরতো কেবল পানি।
স্বশিক্ষিত বাবা আমার সব জ্ঞানীদের সেরা
বাদাম শরীর বুকটা বাবার সরলতায় ঘেরা।

মাওনপুরের হাটে যেতো খালোই নিয়ে হাতে
সন্ধ্যে বেলা ফিরতো বাড়ি সদাই ভরে তাতে
হাটের থেকে ইলিশ এনে রাতেই হতো ভাজা
সেই যে কবে বাবার সাথে ইলিশ খেলাম তাজা।

আজকে আমি অনেক বড় বাবা পরপারে
আমিও আজ বাবা হয়ে দায়িত্বটা ঘাড়ে।
এখন বুঝি ঠিক কতটা বাবার বোঝা ভারি
অনন্ত এক অসীম পথে বাবা সেথায় গাড়ি।


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন (0)
নবীনতর পূর্বতন