মাজহার সরকার এর ‘ঝিকটি ফুলের ক্ষমতা’ শেষ হয়েও হয় না শেষ
জোবায়ের মিলন
আমার অভিজ্ঞতায় দেখেছি, কোনো কোনো কবিতা এক টানে পড়ে শেষ করা যায়।
কোনো কোনো কবিতা পড়তে গিয়ে ধীর লয়ে পড়তে হয় ভয়ে ভয়ে, শব্দ থেকে শব্দ পার হতে সময়
লাগে। কখনো কখনো স্থির বসে থাকতে হয়—শব্দ ও বাক্যের মুখোমুখি হওয়ার অপেক্ষায়। খুঁড়ে
খনন করতে হয় প্রত্যাশিত ছবিটা তুলে আনতে।
আবার এমন হয়, একবারে কিছুতেই তল ছুঁয়ে উদ্ধার করা যায় না কিছু—পাঠক হিসেবে যা পেতে চাই। ফলে দীর্ঘসময় নিয়ে সেই কবিতায় সাঁতরাতে
হয় বুক ভাসিয়ে জলে অথবা উলটো সাঁতারে। এমতাবস্থায় ফিরে ফিরে পাঠের দাবি রাখে আস্ত
কবিতাটি। না হলে অর্থহীন ঠেকে পাঠ।
কবি মাজহার সরকারের ‘ঝিকটি
ফুলের ক্ষমতা’ কাব্যগ্রন্থের কবিতাগুলো অবিকল তা-ই। মোট ৫৬ টি কবিতা নিয়ে
প্রস্তুত গ্রন্থের প্রায় প্রতিটি কবিতা একটি হোঁচটের মধ্যে ফেলে দেয়। পাঠে যেন
উঠতে উঠতে পিছলে পড়ি, ফের উঠে দাঁড়াতে গিয়ে হেলেদুলে উঠি; যখন তার কাব্যভ্রমণে
বাঙময়তার ভেতর দিয়ে পরিভ্রমণ করি নিমগ্ন মনে।
তারপরও কি মণি-মাণিক্য নিয়ে পলায়নের সুযোগ পাই? মোটেই না। শেষ হয়েও
হয় না শেষ। কোথায় যেন বিরাট বক্তব্যের সুরেলা একটা তান আটকে থাকে কানে।
“...বিস্কুট ফ্যাক্টরি থেকে ভেসে আসছে মিষ্টি ময়দার ঘ্রাণ
কে কার ব্যথার তাপ, আনন্দের প্রপাগান্ডা?
শহরে ট্রাক ঢুকে পড়ে, তার চাকার ওজন বুকে নিয়ে
ক্রমে চিহ্নের মুদ্রা জেগে ওঠে প্রাণের মুখশ্রীর ভেতর
কত অক্ষরের অর্থ মুখে নিয়েও শ্বাসের নেই নিজস্ব মানুষ!
কত সময় তন্তুর রূপ ধরে তৃপ্ত বসে থাকে পাথরের টান
একটা পাহাড় ঘুমিয়ে থাকে সময়ের মহিমা নিয়ে
একটা শামুক টেনে নেয় গোটানো গোধূলির মায়া,
মাটিতে কোপ দিয়ে দেখি ছায়া প্রসারিত অপরূপ পলি
শ্রমিক মেয়েরা ফিরছে ঘরে শিশুকে স্তন দেবে বলে
ফ্যাক্টরির চিমনি দিয়ে তখনও উড়ে যায় ঋতুবৃত্তের ধারা।” (বিস্কুটের
ছিদ্র দিয়ে দেখা দুনিয়া)
লক্ষ্য করি, একটি একটি পৃষ্ঠা উল্টিয়ে একটি একটি কবিতা পড়তে গেলে
একটি একটি বিষয়ের ব্যঞ্জনা মৃদুমন্দ একটি ভাবনার কূপে ফেলে দেয়—কবির নির্মাণ শৈলী। আর মনে হয়, তিনি যেন সমাজ দস্তানায় এক
বিচরণ-তপস্বী। বিন্দু বিন্দু ফোঁটায় পা ফেলে ফেলে ভ্রমণ করছেন আপন দৃষ্টির জাল
ফেলে এবং তুলে আনছেন বহমানতার এমন সব ছবি—যা
চিন্তার ভূমিতে নিক্ষেপ করে পাঠকের অন্তর্দৃষ্টি।
“হে মানুষের জীবন, তোমার পদ্ধতির চেয়ে চতুষ্পদের সাক্ষ্যহীন
নির্বাধ ঘোরাফেরা প্রিয় আমার।/ এই শরতের ভূমিষ্ঠ বাতাস, নব সুবর্ণ কষ্টসন্ধ্যার
নির্জন রাত্রির নিচে পৃথিবী আমাকে আবারও জন্ম দেবে।/ তখন হবো শব্দময় করুণার ছলাৎছল
জ্যোতিষ্কের রাতে হংসরাগের বয়ে যাওয়ার উপেক্ষার প্রহর।/...হাতের মুঠোয় অটবীর
অপেক্ষার খোঁজ, আর চিবুকে ডুবছে মইয়ারের বিকেল।/ আহ মানুষ, তোমার শৃঙ্খলের চেয়ে
মীনের উদ্দেশ্যহীন জীবন প্রার্থনা আমার।” (মইয়ারের বিকেল)
ঝিকটি ফুলের ক্ষমতা’র কবিতাগুলোয় বিষয়বস্তু হচ্ছে প্রেম, কাম,
জিজ্ঞাসা, ক্রোধ, দ্রোহ, বিষাদ, বিষন্নতা, প্রাপ্তি ও অপ্রাপ্তির ঘোষ ব্যথা।
উপলব্ধ হচ্ছে নিপুন বোধ। পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র; শৈশব, কৈশোর, তারুণ্য এখানে
যুক্ত। কিন্তু দিনান্তে করোটির ভেতরে কবির যাপন যন্ত্রণা, বেদনার খরতাপ, পোড়নের
চিৎকার, বদলে যাওয়া পটের বিপরীতে নগ্ন চর জেগে ওঠার অভিঘাতে অবিকল বিবস্ত্র
পৃথিবীর শ্রীহীন মুখ এঁকেছেন অতুল্য আর্টে।
বর্ণনায় বিচক্ষণ শিক্ষক, ভাষায় সাবলিল। শব্দ সংকোচনে পরিমিত, বলায়
পরিপাটি। রূপকে, উপমায় শৃঙ্খল। সত্যনিষ্ঠ বাস্তবতার নিখুঁত উচ্চারণ তার কবিতাকে
বিশেষ বৈশিষ্ট্য দান করেছে। ফলে ভাবে উহ্য থেকে প্রতীকে ব্যক্ত হয়ে কবি আমাদেরকে
যে চিত্রটি দেখাতে চেয়েছেন, তা একবার পাঠে নয়, একাধিক পাঠে উন্মোচিত হয় আমাদের
আহ্বানে—কখনো উন্মুক্ত না হয়েই অস্ফুট এক আকাঙ্ক্ষা তৈরি
করে সমাপ্ত রেখা আঁকে, অসমাপ্ত থেকেই। ফলে এক তীব্র আকাঙ্ক্ষা তৈরি হয় গভীর
তৃষ্ণায়।
“...দূরে গেলে চেনা মুখও পরিচয় বদলাতে থাকে/ যদি ফিরে তাকাই, দেখি
গাড়িগুলো পিঁপড়ের মতো/ ব্রিজ থেকে নামছে আর উঠছে যাত্রার ময়দান পথ।/ ব্রিজের তলায়
তখনও তিতাসের জল বইছে টলমল/ প্যাঁক প্যাঁক করে ডাকছে মাঝির বউটির রঙিন পাতিহাঁস/
তার জানুর মতো যোজনবিস্তৃত বিলের গভীরে চোখ/ তার ভেতর একলা বট সহজ কিছু ঘাস রেখে
গেছে/ মোহের ঠোঁটে ডিঙি বাঁধা, মাগরিবের আজান হয় দূরে/ সরে সরে উত্তীর্ণ জনপদে
আসে সহজ জীবনের দাগ।” (উজানিসার ব্রিজ)
অথবা
“...ওই চোখে শুয়ে আছে ঘাসের রঙ/ জলের আলপনা।/ দুই ভ্রুর মাঝখানে
সুর করে আমপারা পড়ে ছোট মৌলবিরা।” (আফরিনের স্নানপুকুর)
এখানে উল্লেখ না করলেই নয় যে, কবি মাজহার সরকারের বলন ভঙ্গিমায়
একটি বুদ্ধিজীবীতার সুনিপুন সাক্ষর আছে, যেন তিনি সারা দিন হাঁটা মানুষ, যেন তিনি
প্রতিটি বিষয়ের অভ্যন্তরে যুগ যুগ ধরে পর্যবেক্ষক, যেন তিনি ছেনে ছেনে, ব্যবচ্ছেদ
করে করে দেখেছেন প্রতিটি বিন্দুর অন্তর্জাম, যেন তিনি নিজের ভেতরে একক নিজ, আপন
অস্তিত্বের নিষ্পাপ পিতা। তাই তিনি বলতে পারেন—
“পৃথিবীর কোনো ফুল কি সত্যি ঝরে পড়ে?
এখানে হিজলের ঝরে পড়া নিয়ে কেউ চিন্তিত নয়
তাদের নিষ্পাপ আশার মুখ আমাকে পীড়া দেয়।” (হিজলের ঝরে পড়া)
মনে হচ্ছে প্রতিটি কবিতা ধরে ধরে যদি বলার সময় পাওয়া যেত, তবে হয়তো
এ গ্রন্থটি থেকে তৈরি করা যেত আরেকটি গ্রন্থ। নিশ্চয়ই মাজহারের কবিতা থেকে আজ না
হোক কাল বা পরশু কেউ না কেউ আরেকটি গ্রন্থ তৈরির উদ্যোগ নেবে; তার কবিতার
অন্তরঃস্থানীয় যে আহ্বান; তারই কারণে।
তবে, কবির সতর্কতার জন্য একটি নোট রাখা যেতে পারে যে, হঠাৎ হঠাৎ
একটি দুটি কবিতায় শব্দের বাহুল্য এলো কিনা, বিরামে ছেদ পড়ল কিনা, স্মৃতিচারণমূলক
কবিতা ক’টি আরও একটু আবেগরহিত হতে পারত কিনা, দেখবেন। আশা করি পরিমার্জন পর্বে তা
ঠিক হয়ে যাবে।
শেষাংশে বলা যায়, এমন কাব্যগ্রন্থের বহুল পাঠ প্রত্যাশা না করাটা
নির্ঘাত অন্যায় হবে। আমি সেই অন্যায়টি করতে পারছি না বিধায়, মাজহার সরকারের ‘ঝিকটি
ফুলের ক্ষমতা’ কাব্যগ্রন্থটির উত্তরোত্তর সাফল্য কামনা করছি, কিছু ভালো কবিতার
প্রতি ভালোলাগার আন্তরিকতায়।
বই: ঝিকটি ফুলের ক্ষমতা (কবিতা)
কবি: মাজহার সরকার
প্রচ্ছদ: রাজীব দত্ত
প্রকাশনী: জাগৃতি
মূল্য: ২৬০ টাকা।