জাতীয় ভাষানীতি চাই :: সৈয়দ নাজমুল আহসান

জাতীয় ভাষানীতি চাই :: সৈয়দ নাজমুল আহসান

ভাষা হলো জীবজগতের পরস্পরের মধ্যে যোগাযোগ, ভাবের আদানপ্রদানের অন্যতম মাধ্যম। তবে মানুষের জন্য ভাষা হলো মানুষের মুখ নিঃসৃত অর্থপূর্ন-অর্থবহ ধ্বনি বা বর্ণের সমষ্টি। তবে ভাষার এই গঠন শৈলী নিয়ে পণ্ডিতগণ একমত পোষণ করলেও ভাষার একক চূড়ান্ত সংজ্ঞা পাওয়া যায়নি আজো।

ভাষার সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বহুভাষাবিদ ড. মুহম্মদ শহীদুউল্লাহ লিখৈছেন‘মনুষ‍্যজাতি যে ধ্বনি বা ধ্বনিসকল দ্বারা মনের ভাব প্রকাশ করে তার নাম ভাষা।’ বাংলা ভাষার আরেক পণ্ডিত ড. সুনীতি কুমার চট্টোপাধ্যায়ের মতে‘মনরে ভাব প্রকাশরে জন্য বাগযন্তের সাহায্যে উচ্চারিত, ধ্বনি দ্বারা নষ্পিন্ন, কোনো বিশেষ জনসমাজে ব‍্যবহৃত, স্বতন্ত্রভাবে অবস্থিত, তথা বাক‍্যে প্রযুক্ত শব্দসমষ্টিকে ভাষা বলে।’

বর্তমান বিশ্বে বাংলা ভাষাসহ মোট ভাষার সংখ্যা ৭,০৯৭ টি। যার মধ্যে প্রাতিষ্ঠানিক ভাষা ৫৮০ টি, শক্তিশালী ২,৪৪৬ টি, বিকাশমান ভাষা ১,৫৯০ টি, সংকটাপন্ন ভাষা ১,৫৫৯ টি এবংবিলুপ্তি পথে ৯২২ টি ভাষাকে ধরা হয়। বিশ্বের প্র্রায় ২৮ কোটি মানুষ বাংলায় কথা বলে। যা বিশ্বের মোট জনসংখ্যার ১৫ শতাংশ বলা চলে। বিশ্বের বহুল ব্যবহৃত মোট ব্যবহারকারীর সংখ্যা অনুসারে বাংলা বিশ্বের সপ্তম ভাষা। বাংলা আমাদের মাতৃভাষা। কারণ আমরা আমাদের মায়ের কাছ থেকে এই ভাষা শিখেছি। আর মায়ের কাছ থেকে শেখা মাতৃভাষা বা মাদার ল্যাগুয়েজ এমন একটি ভাষা যা শিশু জন্মের আগে মায়ের গর্ভাবস্থায় পরিচিত হয়। মানুষ মাতৃভাষাতেই কথা বলতে সবচেয়ে বেশি পারদর্শী হয়ে থাকে। বিশ্বের মাতৃভাষা ব্যবহারে আমাদের মাতৃভাষা বাংলা পঞ্চম অবস্থান করছে।

 

আমাদের স্বাধীন, সার্বভৌম রাষ্ট্র বাংলাদেশের একমাত্র রাষ্ট্র ভাষা বাংলা। কিন্তু আমাদের মাতৃভাষা বাংলা রাষ্ট্র ভাষার মর্যাদা প্রাপ্তির  ইতিহাস স্বাধীনতার পূর্বে ভাষা শহিদদের তাজা রক্তের বিনিময়ে পাওয়া এক সংগ্রামী রক্তাক্ত অধ্যায়ের ইতিহাস। দিনটা ছিল বৃহস্পতিবার, বাংলা বর্ষপঞ্জিকাতে ৮ ফাল্গুন ১৩৫৮ বঙ্গাব্দ। আর গ্রেগরীয়ান বর্ষপঞ্জিতে ২১ ফেব্রুয়ারি ১৯৫২ খ্রীষ্টাব্দ। সেদিন মায়ের ভাষা বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবীতে আন্দোলনরত বাঙালিদের উপর পাকিস্তানি শাসক শ্রেণির লেলিয়ে দেওয়া রক্তপিপাসু হায়েনাদের চকচকে বুলেটে বিদ্ধ হয়ে শহিদ হয়েছিল বরকত, রফিক, জব্বার, সালামসহ নাম না জানা আরো অনেক বাঙালি তরুণ। মাতৃভাষাকে রাষ্ট্রভাষা হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করার দাবীতে ঢাকার রাজপথে ঘটে যাওয়া ৮ ফাল্গুনের (২১ ফেব্রুয়ারি) রক্তাক্ত ঘটনাটি আজো পৃথিবীর ইতিহাসে ব্যতিক্রমধর্মী এক অনন্য ঘটনা। বাংলাদেশ এবং বাঙালির ইতিহাসে রক্তাক্ত  ঐতিহাসিক এই দিনটি অধিকার আদায় তথা অধিকার সচেতনার আলোকবাতি হয়ে আজো স্মরণীয়-বরণীয় হয়ে আছে। 

ভাষা শহিদদের বুকের তাজা রক্তের বিনিময়েই বাংলা ভাষা রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা লাভ করে।  রক্তাক্ত ৮ ফাল্গুনের (২১ ফেব্রুয়ারি) বাঙালির ইতিহাসে তথা ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসে স্মরণীয়-বরণীয় একটি পবিত্র দিন। ভাষা আন্দোলনের এ দিনটি বাঙালির অধিকার আদায়ের প্রতিক। একটি চেতনাকে জাগ্রত করার প্রেরণা, বাঙালি সাহিত্য-সংস্কৃতির অনুপ্রেরণা। বাংলাদেশের ইতিহাসে বাংলা ১৩৫৮ সনের ৮ ফাল্গুন আর ইংরেজি ১৯৫২ সনের ২১ ফেব্রুয়ারি ভাষা আন্দোলনের ঐতিহাসিক দিনটি পরাধীন জাতির মুক্তির অগ্নিমশাল-বাতিঘর। কারণ ’৫২র ভাষা আন্দোলনের পথ ধরেই এসেছিল ১৯৭১ এর স্বাধীনতা সংগ্রাম, মুক্তিযুদ্ধ। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশে ভাষা শহিদ দিবস, জাতীয় দিবসের মর্যাদা প্রাপ্তির পর আজ আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের মর্যাদা লাভ করেছে। এটা পৃথিবীর সমস্ত বাংলা ভাষাভাষির জন্য গর্ব আর গৌরবের বিষয়।

 

আজ আমাদের স্বাধীন ভূখণ্ড আছে, মানচিত্র আছে, পতাকা আছে। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য ’৫২ ভাষা আন্দোলনের পর ৭২ বছর পেরিয়ে গেলেও আজও আমরা আমাদের জাতির সেইসব বীরসন্তান ভাষাসংগ্রামীদের প্রকৃত সম্মান দিতে পারছি না। তাঁদের আজন্মলালিত স্বপ্ন মাতৃভাষা বাংলার প্রকৃত মর্যাদা দিতে পারছি না। যদিও ভাষা আন্দোলনের সংগ্রামী ইতিহাস আছে আমাদের। তবুও ইতিহাস গড়তে পারিনি মাতৃভাষার প্রতি প্রকৃত সম্মান প্রদর্শনের ক্ষেত্রে। মাতৃভাষা বাংলার প্রমিত উচ্চারণ, শুদ্ধ বাংলা চর্চা তথা সর্বস্তরে বাংলা ভাষা ও বাংলা সনের প্রচলন করতে পারছি না। ‘বাংলিশ’ নামক এক অদ্ভুত ভাষা প্রয়োগ করে আমরা যেন মাতৃভাষা বাংলার বিলুপ্তি ঘটাতে যাচিছ। এমনিতেই সর্বস্তরে বাংলা ভাষার ব্যবহার আইন করেও মানা হচ্ছে না। দোকান ও প্রতিষ্ঠানের নামফলকে বাংলা ব্যবহারে পরিপূর্ণতা আসেনি। আদালতে রায়ে বাংলা ব্যবহারে শতভাগ পূর্নতা নেই। প্রশাসনের দাপ্তরিক কাজেও একই অবস্থা। চিকিৎসকরাও তাদের চিকিৎসাপত্রে বাংলার প্রয়োগ চালু করছেন না। আর সন তারিখ ব্যবহারের ক্ষেত্রে-তো দশভাগও প্রয়োগ হচ্ছে না। একবাক্যে বলা চলে সর্বস্তরে বাংলা ভাষার চর্চায় বাঙালিদের মনের প্রভাব ফেলছে না। ভেতর থেকে তাগিদ না আসলে সংস্কৃতির চর্চা হয় না। চেতনার জন্য ভেতর থেকে বেদনার প্রসব ঘটাতে হয়। যা সাত দশকেও হয়নি আমাদের। জাতীয় সংস্কৃতি চর্চার ক্ষেত্রে অধিকাংশ কৃত্রিমতা মেকি মনে হয়। নইলে তো চর্চা একদিনে সীমাবদ্ধ না হয়ে ৩৬৪ দিনে প্রয়োগ দেখা যেতো ।

আমরা মাতৃভাষার প্রকৃত মর্যাদা রক্ষা, ভিনদেশি ভাষার আগ্রাসন, লেজুড়বিত্তি ঠেকাতে পারছি না। রাষ্ট্রে জোড়ালো ভাষানীতি না থাকায় ভাষার উপর আঘাত প্রতিঘাত বাড়ছেই। স্বাধীনতার পাঁচদশক পেরিয়ে গেলেও জাতীয় ভাষানীতি প্রণীত না হওয়ায় সংকট ঘনীভূত হচ্ছে।

সফল আন্দোলনের সাত দশক পেরিয়ে গেলেও ভাষার প্রকৃত মর্যাদার বিশ্লেষণে বিব্রতবোধ করি। মুখোমুখি হতে হয় নানান প্রশ্নের। আমরা কি মাতৃভাষা বাংলার প্রকৃত মর্যাদা দিতে পারছি সর্বক্ষেত্রে, সর্বস্তরে কি বাংলার প্রচলন রয়েছে, পরিবারে, সমাজে, রাষ্ট্রে? সর্বক্ষেত্রে বাংলা ভাষা কি তার স্বকীয়তা বজায় রাখতে সক্ষম হচেছ? ভিনদেশী ভাষার আগ্রাসী আক্রমনে বাংলা ভাষা কি দুর্বল হয়ে পড়ছে? উচ্চারণে, ব্যবহার, লেখনে-পঠনে, গঠনে বাংলা ভাষার কি দুরবস্থা চলছে? চলমান বাংলা ভাষার সার্বিক উন্নতির চিত্রে আমরা কি আশাবাদি? প্রশ্নগুলেরা সদুত্তর নেই আমাদের কাছে।

পৃথিবীর একমাত্র ভাষাভিত্তিক রাষ্ট্র বাংলাদেশ স্বাধীনতার অর্ধশত বছর পেরিয়ে গেলেও রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে জাতীয় ভাষানীতি প্রণীত হয়নি। তাই রাষ্ট্রভাষা বাংলার সার্বিক কল্যাণে তথা বাংলা ভাষার মর্যাদা সমুন্নত রাখতে জরুরী ভিত্তিতে ‘‘জাতীয় ভাষানীতি” প্রণয়ণের প্রস্তাব করছি। আমার প্রস্তাবটি বাংলা একাডেমির বার্ষিক সভায় গৃহীত হয়েছে। প্রস্তাবিত জাতীয় ভাষানীতি ভাষার মর্যাদা অক্ষুন্ন রাখতে বাংলা ভাষার প্রতি মমত্ববোধ বাড়াতে, বাংলা ভাষার উপর ভিনদেশী ভাষার আগ্রাসন ঠেকাতে, বাংলিশ প্রতিরোধে ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে সহায়ক হতে পারে। কার্যকর ভাষানীতি থাকলে ভাষাশহিদ, ভাষাসৈনিক, ভাষাসংগ্রামীদের তালিকা প্রণয়ন, জাতীয় বীরের মর্যাদা প্রদান, শহিদ মিনার সমূহের সংরক্ষন, মর্যাদা এমনকি ভাষাপুলিশ গঠনেও ইতিবাচক ভূমিকা পালন সহজতর হয়। সেই সাথে প্রস্তাবিত জাতীয় ভাষানীতিতে  ৮ ফাল্গুনের ঐতিহাসিক চেতনা প্রজন্ম থেকে প্রজন্মের কাছে উজ্জীবীত রাখতে বাংলা বর্ষপঞ্জির ফাল্গন মাসকে ভাষার মাস এবং ভাষা আন্দোলনের মাস ঘোষণা করার দাবী করছি। যা বাস্তবায়নে পদক্ষেপ নেয়া জরুরী।   

 

অমর ২১ ফেব্রুয়ারি আজ আর শুধু আমাদের শহিদ দিবস-ভাষা দিবসই নয় এদিনটি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবেও পালিত হচেছ। তাই জাতীয় তথা আন্তর্জাতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ মাতৃভাষা দিবসের মর্যাদা রক্ষা করতে আমাদেরকে ভাষা শহিদ, ভাষাসংগ্রামীদের স্বপ্ন বাস্তবায়নে কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে জাতীয় স্বার্থে, আগামী  প্রজন্মের স্বার্থে। মাতৃভাষাকে অবজ্ঞা করে কোন জাতি মাথা উচু করে দাড়াতে পারে না। মনে রাখা উচিত মাতৃভাষাকে অবজ্ঞা করা মানে, মাকে অবজ্ঞা করার শামিল। বিদেশীদের অনেক কিছুই আমরা অনুকরণ করছি। দূর্ভাগ্য চীন, জাপান, জার্মানী, ফ্রেঞ্জ, বৃটেন আমেরিকানদের মতো তাদের মাতৃভাষার অগ্রাধিকারের বিষয়টি অনুকরণও করছি না অনুসরণেরও চেষ্টা করি না। মাতৃভাষা বাংলার প্রতি আমাদের আবেগ অনুভূতি চেতনাবোধগুলোকে জাগ্রত করতে হবে। মা মাটি মাতৃভাষা মাতৃভূমির প্রতি মমত্ববোধকে আরো প্রসারিত করতে হবে। সব মিলিয়ে বলা চলে মাতৃভাষা তথা বাংলা ভাষার মর্যাদা বৃদ্ধিতে জাতীয় ভাষানীতি প্রণয়ণ এখন সময়ের অন্যতম দাবী। আসুন জাতীয় ভাষানীতি প্রণয়নে ঐক্যবদ্ধ হই। উচ্চারণ করি-

বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষায় তাই

জাতীয় ভাষানীতি চাই।।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন (0)
নবীনতর পূর্বতন