জালাল স্যার : মানুষ গড়ার অদম্য কারিগর এবং কিছু স্মৃতি
ইয়াসিন
আযীয
‘জালাল স্যার’ হিসেবে তিনি সর্বাধিক পরিচিত হলেও—তাঁর পুরো নাম ‘জালাল উদ্দিন আহমেদ’। সবাই তাঁকে জালাল স্যার নামেই
ডাকেন। তাঁর জন্ম—১৯ আগস্ট ১৯৩৮ সালে পালং থানার তুলাসার গ্রামে। বাবা আলেক চাঁন
বেপারী এবং মা জয়তুন বিবীর ৩য় সন্তান তিনি। ১৯৪৬ সালে ধানুকা ফ্রি-প্রাইমারি
স্কুলে ভর্তির মাধ্যমে শিক্ষা জীবন শুরু করেন জালাল স্যার। এরপর তুলাসার হাই
(ইংলিশ) স্কুলে ভর্তি হয়ে ১৯৫৮ সালে ম্যাট্রিক, ১৯৬২ সালে মাদারীপুর নাজিমউদ্দিন
কলেজ থেকে আইএ, ১৯৬৬ সালে জগন্নাথ কলেজ থেকে বিএ এবং ১৯৬৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
থেকে এমএ (প্রাইভেট) প্রথম পর্ব পাস করের। ১৯৬৭ সালে পালং তুলাসার গুরুদাস সরকারি
উচ্চ বিদ্যালয়ে সহকারী শিক্ষক হিসেবে যোগদানের মাধ্যমে তিনি কর্মজীবন শুরু করেন।
জালাল স্যারের নাম আমি প্রথম শুনি আমার আব্বার কাছে। ১৯৭১ সালে
স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে যুদ্ধবিধ্বস্ত ও খাদ্য সংকটে পড়া নতুন স্বাধীন বাংলাদেশে
বিভিন্ন দেশ এবং দেশি-বিদেশি বিভিন্ন সংস্থা থেকে সাহায্য আসতে থাকে। সে সাহায্য
প্রান্তিক পর্যায়ে পৌঁছে দেওয়ার জন্য ইউনিয়নভিত্তিক রিলিফকমিটি গঠন করা হয়। সেই
কমিটিতে জালাল স্যার ছিলেন তুলাসার ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আর আমার আব্বাসহ অনেকেই
ছিলেন মেম্বার বা সদস্য। সে-সব দিনের গল্প আব্বা প্রায়ই বলতেন বিভিন্ন কথা
প্রসঙ্গে। সেখান থেকেই ছোটোবেলা থেকে জালাল স্যারের নাম আমি শুনে আসছিলাম। আব্বা
অবশ্য সম্মোধন করতেন ‘জালাল মাষ্টার’ বলে। একটি বিষয় বলে রাখা ভালো—তখন তুলাসার ও ধানুকা গ্রাম, তুলাসার স্কুলসহ শরীয়তপুর পৌরসভার অধীন জেলা
শহরের অনেকটাই ছিল (পালং ইউনিয়ন পর্যন্ত) তুলাসার ইউনিয়নের আওতাভুক্ত।
আমাদের পাশের গ্রাম বাইশরশির সহপাঠী জাহাঙ্গীর এবং প্রতিবেশী রফিক মিলে কীর্তিনাশা নদীর ধারে এবং বর্ষায় নৌকায় চড়ে আমরা আড্ডা দিতাম। আমরা সারাদিনে নিজেদের সাথে ঘটে যাওয়া ঘটনা একে অপরের সাথে শেয়ার করতাম। রফিক অবশ্য ছিল আমার এক ব্যাচ জুনিয়র। আমি তখন এইচএসসি শেষ করে অনার্সে ভর্তির অপেক্ষায় ছিলাম। জাহাঙ্গীরের পড়াশোনায় একবছর গ্যাপ হওয়ায় রফিক এবং জাহাঙ্গীর ছিল এইচএসসি পরীক্ষার্থী। ওরা জালাল স্যারের বাসায় ইংরেজি পড়তে যেত। সেখানকার পড়াশুনা এবং পড়াশুনার বাইরে ঘটে যাওয়া বিভিন্ন বিষয় শেয়ার করত আড্ডায়। নিজের অভিজ্ঞতা থেকে জানি—জালাল স্যার শুধু পাঠ্য বই পড়িয়েই ক্ষান্ত হতেন না। জীবনের নানা দিক নিয়ে আলোচনা করতেন এবং মানুষের মতো মানুষ হওয়ার অনেক বিষয়ে দীক্ষা দিতেন। ওরা আবার আমার সাথে সে-সব বিষয় শেয়ার করত। আব্বার কাছে ছোটোবেলা থেকে জালাল স্যারের নাম শোনা এবং ওদের কাছে আড্ডায় প্রায়ই জালাল স্যারের প্রসঙ্গ চলে আসায়, জালাল স্যারকে না দেখেও যেন, তিনি আমার অনেক দিনের চেনা হয়ে গিয়েছিলেন। পাশাপাশি তাঁর নামটাও আমার মুখস্থ হয়ে গিয়েছিল। আমার ছোট্ট একটা টেপ রেকর্ডার ছিল তখন। আমি আড্ডায় প্রায়ই সেই রেকর্ডারটি নিয়ে যেতাম। বিখ্যাত সব শিল্পীদের ভারতীয় বাংলা ক্লাসিক্যাল গানের একটি ক্যাসেট ছিল আমার। অনেক সময় ক্যাসেটটি বাজাতাম। ক্যাসেটটিতে একটি গান বাজতেই প্রসঙ্গ চলে আসতো জালাল স্যারের। স্যারের স্ত্রী মারা যান ১৯৯৭ সালে। ওরা যে বছর জালাল স্যারের কাছে পড়তে যেত ততদিনে স্যারের স্ত্রীর মৃত্যুর অর্ধযুগ পার হয়ে গেছে। তবুও স্ত্রীকে ভুলতে পারেননি স্যার। সহধর্মিণীকে স্যার প্রচণ্ড রকম ভালোবাসতেন। তার শোবার ঘরে তাঁদের যুগল ছবি টাঙানো আছে আজও। স্ত্রী মারা যাওয়ার পর থেকেই স্যারের প্রিয় হয়ে ওঠে আমাদের আড্ডায় শোনা এই গানটি—
‘যেতে
যেতে গান খানি পিছে ফেলে গেছে
ঝমঝম
নুপূরের-ও সকরুনো সুর
শিকলে
বাধিতে তারে চেয়েছিনু বুঝি
শিকল
চরণে তার হয়েছে নূপুর
ধরার
বাঁধনে সে তো ধরা পড়ে না
মনের
জানালা ধরে উঁকি দিয়ে গেছে
যার
চোখ তাকে আর মনে পড়ে না
চেয়ে
চেয়ে কতো রাত দিন কেটে গেছে
আর
কোনো চোখ তবু মনে ধরে না
মনের
জানালা ধরে উঁকি দিয়ে গেছে।’
আমি অনার্স কমপ্লিট করার পর মোবাইল অপারেটর কোম্পানি গ্রামীণফোনের শরীয়তপুরের এজেন্ট অফিসে চাকরিতে যোগ দেই। এর কিছুদিন পর শরীয়তপুর হরিসভার পূর্ব পাশের বণিক বাড়ির আমার এক বন্ধু হিমেল কুমার বণিক—যাকে আমি ‘ঠাণ্ডা কুমার’ নামে ডাকি। ও আমাকে নিয়ে যায় জালাল স্যারের কাছে। সময়টি ছিল ২০১০ সাল। জালাল স্যার তখন শরীয়তপুর জেলা প্রশাসন কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত ও পরিচালিত কালেক্টরেট পাবলিক উচ্চ বিদ্যালয়ের পরিচালক ও প্রধান শিক্ষক। আমি সেখানে কমার্সের (ব্যবসায় শিক্ষা) শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পেলাম। এই স্কুল সম্পর্কে আমার পূর্ব ধারণা ছিল না। জালাল স্যার স্কুলটির সাথে জড়িত তা-ও জানতাম না। হিমেল জালাল স্যারের কাছে নিয়ে গিয়ে আমাকে একরকম সারপ্রাইজ দিলো। শিক্ষকতা আমার প্রিয় পেশা। মা-ও চেয়েছিলেন আমি স্কুলে মাস্টারি করি এবং বাড়ির কাছাকাছি থাকি। হিমেল আমাকে স্যারের সাথে পরিচয় করে দেয়। পরিচয়ে আমি অবাক হলাম। ছোটোবেলা থেকে নাম শুনে আসা একজন আইডল আমার সামনে। আমি পরিচয় দিতে গিয়ে আব্বার কথা বললাম। আব্বার কাছে তাঁর নাম ছোটোবেলা থেকেই আমি শুনে আসতেছি জানালাম। স্যার বললেন—‘তোমার বাবা বেঁচে আছেন?’ আমি জবাবে বললাম—‘আছেন।’ স্যার বললেন—‘একদিন নিয়ে এসো।’ সেদিন স্যার আমাকে স্কুলের ধরণ, শিক্ষা পদ্ধতি, শিক্ষক, ছাত্রছাত্রী এবং স্কুলের বিভিন্ন বিষয়ে ধারণা দিলেন। আমাকে আগের কমার্সের (ব্যবসায় শিক্ষা) শিক্ষকের রিপ্লেসমেন্ট হিসেবে ক্লাস রুটিন বুঝিয়ে দিলেন।
সমস্ত শিক্ষকগণই মানুষ গড়ার কারিগর। কিন্তু আমি আমার লেখার শিরোনামে
জালাল স্যারকে মানুষ গড়ার ‘অদম্য কারিগর’ বলে অবিহিত করেছি। অদম্য বিশেষণটি
স্যারের ক্ষেত্রে যোগ করার অন্যতম কারণ—জালাল স্যার কালেক্টরেট স্কুলে
যোগ দেওয়ার পূর্বে দীর্ঘ ৩১ বছর সুনামের সাথে শিক্ষকতা করে তুলাসার হাইস্কুলের
প্রধান শিক্ষক পদ থেকে অবসর নেন। তিনি অতিরিক্ত দায়িত্ব হিসেবে শিক্ষা কর্মকর্তার দায়িত্বও
পালন করেন। এছাড়াও নিয়মিত ছাত্র পড়াতেন স্যার। আজীবন তিনি শিক্ষা বিস্তার এবং
শিক্ষা সংশ্লিষ্ট কাজেই অতিবাহিত করেছেন। কালেক্টরেট স্কুলের দায়িত্বটা ছিল তার
জন্য কিছুটা ব্যতিক্রম। যা স্যার আমাকে প্রথম দিনেই বুঝিয়ে দিলেন। আসলে স্কুলটিতে
ভর্তি হতো দুই ধরণের ছেলেমেয়ে। এক—একটু কম মেধাবী, যারা অন্য
স্কুলগুলোতে চান্স পেতো না। দুই—একটু গরীব শ্রেণির পরিবারের
শিক্ষার্থীরা। যারা সময় মতো স্কুল ও প্রাইভেট ফি দিতে পারাতো না এবং বই-খাতা কিনতে
পারতো না; ফলে মেধা থাকা সত্ত্বেও অন্যান্য স্কুল থেকে ড্রোপ আউট হয়ে যেত। আসলে
আমরা দেখতে পাই দেশের যে সকল নামিদামি স্কুল রয়েছে সেখানকার শিক্ষকগণ বাছাই করা
গুণী ও মেধাবী শিক্ষক। পাশাপাশি স্বচ্ছল পরিবারের মেধাবী শিক্ষার্থীরা পড়াশুনা করে
সেখানে। ফলে তাদের রেজাল্ট ভালো না হওয়ার উপায় কী? কিন্তু তখনকার আমার সদ্য
যোগানকৃত স্কুলটি সম্পূর্ণ বিপরীত—যা স্যার আমাকে সুন্দরভাবে
বুঝিয়ে দিলেন। কম মেধাবী, গরীব এবং ঝরে পড়তে চলা এরকম ছাত্র-ছাত্রীদের ঘষেমেজে
পরীক্ষায় পাশের উপযুক্ত করে গড়ে তোলা চারটিখানি কথা নয়। সেই কাজটিই করতেন এবং
আমাদের দিয়ে করাতেন জালাল স্যার। কেরানী সাহেব পরীক্ষার সময় যখন বলে দিত—‘যারা পরীক্ষার ফি এবং বেতন দিতে পারবে না, তারা পরীক্ষায় অংশগ্রহণ
করতে পারবে না।’ তখন দেখতাম অনেক গরীব অভিভাবক আসতো জালাল স্যারের কাছে। স্যার
বলতেন—‘কত টাকা আনছো, কত দিতে পারবা? আচ্ছা পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করুক। পরে
দিয়ে দিও।’ আমরা যারা পড়াতাম তাঁরাও পেতাম নাম মাত্র সম্মানী। যা চলে যেত আমার
যাতায়াত ভাড়া দিতেই। তবুও ভালো লাগতো। ভেতরে আনন্দ অনুভব হতো জ্ঞানের আলো জ্বালাতে
পেরে। স্যার টাকাটা দেওয়ার সময় শিক্ষকদের বলতেন এইটা আপনাদের বেতন দিলাম না,
সম্মানী দিলাম। আমরা আনন্দের সাথে সম্মানী গ্রহণ করতাম স্যারের কাছ থেকে।
জালাল স্যার ক্লাসের ফাঁকে, টিফিনে শরীয়তপুর জেলার বিভিন্ন
বিষয়ভিত্তিক ইতিহাস নিয়ে আলোচনা করতেন। ভাষা আন্দোলন পরবর্তী শরীয়তপুরে শহীদ মিনার
তৈরি, মুক্তিযুদ্ধ, খেলাধুলা প্রভৃতি থাকত তাঁর আলোচনার বিষয়বস্তু। তিনি সরাসরি
মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ না করলেও, ছিলেন শরীয়তপুরে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতিটি
অপারেশনের পরিকল্পনার অংশ। অনেক ক্ষেত্রে তিনি অপারেশন পরিকল্পনার মাস্টারমাইন্ড
হিসেবেও কাজ করেছেন। সে-সব দিনের অনেক গুরুত্বপূর্ণ গল্প তিনি আমার সাথে শেয়ার
করতেন। ইতিহাস ঐতিহ্য আমার প্রিয় বিষয় হওয়ায় আমি ছিলাম তাঁর একনিষ্ঠ শ্রোতা। তিনি
বলেছিলেন তার পাশের বাড়ির এক রাজাকার কী করে মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে
মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে—এরকম অসংখ্য গল্প।
কালেক্টরেট স্কুলের ছাত্রছাত্রীরা তখন বেড়া চিকন্দি হাইস্কুলের নামে
এসএসসিতে অংশ গ্রহণ করত। বেড়া চিকন্দি হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক মাজাহারুল ইসলাম
স্যার ছিলেন আমার ছোটোবেলার শিক্ষক। তিনি আমার অত্যন্ত প্রিয় একজন শিক্ষক। যিনি
আবার জালাল স্যারের ছাত্র ছিলেন। তার বাসা ছিল কালেক্টরেট স্কুলের পূর্ব পাশে।
তিনি প্রায়ই আসতেন জালাল স্যারের সাথে দেখা করতে। তাই আমি জালাল স্যারের প্রসঙ্গ
উঠলে অন্যদের বলতাম জালাল স্যার আমার স্যারেরও স্যার। শুধু তাই নয়—আমি জালাল স্যারের ছাত্রের ছাত্র হওয়া সত্ত্বেও স্বল্পকাল তাঁর সহকর্মী
হওয়ার সুযোগ পাওয়ায় গর্ববোধ করতাম। যাই হোক আমার বেশি দিন জালাল স্যারের সহকর্মী
হয়ে শিক্ষকতা করা হয় না—আমি চলে যাই আমাদের পাশের
গ্রামের ‘আবু তালেব মাস্টার হাইস্কুলে’। এরপর মাঝে মধ্যে স্যারের সাথে দেখা হলেই
জানতে চাইতেন—‘তোমার বাবা কেমন আছেন? একদিন নিয়ে এসো।’ আব্বাকে একদিন বললাম
বিষয়টি। নিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা করলাম। এর কিছুদিন পর আব্বা না ফেরার দেশে চলে
গেলেন। আব্বার মৃত্যুর কিছুদিন পর ২০১৮ সালের দিকে জালাল স্যারের সাথে দেখা হলে
আবার সেই একই কথা বললেন। আমি বললাম—‘আব্বাতো গত ২৬ মার্চ মারা
গেছেন।’ স্যার শুনে দুঃখ প্রকাশ করলেন।
একবার স্যারের সাথে অনেক দিন পর দেখা শরীয়তপুর শহীদ মিনারের সামনে
একুশের বইমেলায়। সময়টা ২০১৫ সাল হবে। স্যারের হাতে কবি ও সম্পাদক খান মেহেদী মিজান
সম্পাদিত ‘কীর্তিনাশার কাব্যে’র প্রথম
সংখ্যা। তখন আমি এর সম্পাদনার সাথে যুক্ত হওয়াতো দূরের কথা ‘কীর্তিনাশার কাব্যে’র নামও শুনিনি। শুধু তাই নয় শরীয়তপুরের কবি
সাহিত্যিকদের কারো সাথেই আমার পরিচয় হয়নি তখনো। স্যার কীর্তিনাশার সংখ্যাটি খুলে
আমাকে তাঁর কবিতা দেখালেন। দেখি স্যারের পাশাপাশি আমার বড়ো ভাইয়েরও কবিতা আছে
সংখ্যাটিতে। আমি সাথে সাথে এক কপি কিনে নিলাম। জালাল স্যার লেখালেখি করেন সেটা
জানতাম না। তবে স্যার ছোটোবেলা খেলাধুলায় খুবই পারদর্শী ছিলেন সেটা জানতাম। সে
গল্প একাধিকবার শুনিয়েছেন তার সহকর্মী থাকাকালে। স্যার একবার আন্তঃজেলা খেলায়
অংশগ্রহণ করেছিলেন তুলাসার স্কুলের হয়ে ফরিদপুর গিয়ে। তখন আমাদের জেলা ছিল
ফরিদপুর। স্যার তিনটি খেলার মধ্যে তিনটিতেই প্রথম হন। তাই তাঁকে তিনটিসহ আরো একটি
স্পেশাল পুরস্কার প্রদান করা হয়। তিনি যখন মঞ্চে উঠেছিলেন পুরস্কার গ্রহণ করতে তখন
পুরস্কার বিতরণকারী অফিসার (এসডিও বা জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা) স্যারকে বলেছিলেন—‘You are too little but too genius.’
জালাল স্যার নিজের কাজ নিজেই করতে পছন্দ করতেন। মৃত্যুর আগের দিন পর্যন্ত যা অব্যাহত ছিল বলে জানা যায়। তিনি একজন সু-সংগঠক ছিলেন। দায়িত্ব পালন করেছেন শিল্প-সংস্কৃতিসহ বিভন্ন সংগঠনের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে। ঢাকাসহ শরীয়তপুর জেলার বিভিন্ন স্থানে, অসংখ্য মঞ্চ নাটকে অভিনয় করেছেন। ছিলেন চমৎকার একজন আবৃত্তিকার। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘দুই বিঘা জমি’ কবিতাটি চমৎকার আবৃত্তি করতেন তিনি। গত ২৬ ডিসেম্বর ২০২৪ শরীয়তপুর পাবলিক লাইব্রেরীর সামনে রথীন্দ্রকান্ত ঘটক চৌধুরীর ১০৩ তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষ্যে আয়োজিত আলোচনা অনুষ্ঠানে সর্বশেষ কবিতা আবৃত্তি করেন তিনি। এত বয়সে এসেও কাঁপা কাঁপা কন্ঠে নির্ভুলভাবে আবৃত্তি করে শুনান—যা সকলকে অবাক করে। গত ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ খ্রি. তারিখ শরীয়তপুর পৌর অডিটরিয়ামে ‘শরীয়তপুর সাহিত্য সংসদ’ এর চতুর্থ প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী ও সাহিত্য পুরস্কার ২০২৫ এবং শরীয়তপুর সাহিত্য সংসদের মুখপত্র ঢেউ এর মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠানে জালাল স্যারকে সম্মাননা ক্রেস্ট প্রদান করা হয়। ভাষাসৈনিক হিসেবে ভাষার মাসে এই সম্মাননা ক্রেস্ট প্রাপ্তি ছিল তাঁর জন্য খুবই গর্বের। যা তিনি তাঁর অনুভূতি প্রকাশ করতে গিয়ে ব্যক্ত করেন। তিনি সেদিন ‘শরীয়তপুর সাহিত্য সংসদ’ এর প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক সুপান্থ মিজানসহ সংস্লিষ্ট সকলের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে অনুভূতি ব্যক্ত করেন। সম্ভাবত এটাই ছিল তাঁর কোনো শিল্প-সাহিত্য অনুষ্ঠানে শেষ অংশগ্রহণ এবং আমার সাথে শেষ সাক্ষাৎ।
আমি শরীয়তপুরের ইতিহাস ঐতিহ্য নিয়ে কিছুটা লেখালেখির চেষ্টা করি। জালাল স্যার শরীয়তপুর জেলার অন্যতম প্রবীণ ব্যক্তিত্ব ছিলেন এবং সাহিত্যিক ও সমাজ সেবক রথীন্দ্রকান্ত ঘটক চৌধুরীর সরাসরি স্নেহধন্য ছাত্র ছিলেন। রথীন্দ্রকান্ত ঘটক চৌধুরীরকে নিয়ে আমার গবেষণামূলক কাজ রয়েছে। আমার আরো কাজ করার ইচ্ছে আছে ঘটক চৌধুরীরকে নিয়ে। পাশাপাশি শরীয়তপুরের মুক্তিযুদ্ধ নিয়েও আমার কাজ করার ইচ্ছা আছে। একযুগ আগে শরীয়তপুরের মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কিত জালাল স্যারের কাছ থেকে শোনা অনেক তথ্যই ভুলে গেছি। তাই জালাল স্যারের সাথে সাক্ষাতে বলেছিলাম নতুন করে বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা করা দরকার—যাতে একটু ঝালিয়ে নিতে পারি। স্যার আমাকে যেতে বলেছিলেন। এবারের একুশে বইমেলায় শরীয়তপুর শিল্পকলা মাঠে তাঁর একটি স্টল ছিল শরীয়তপুরের ভাষা সংগ্রামীদের নামে; সেখানে সর্বশেষ অনেকক্ষণ কথা হয় স্যারের সাথে। তার সংগ্রহে থাকা তুলট কাগজে হাতে লেখা বাংলা হরফে সংস্কৃত পাণ্ডুলিপি আমাকে দেখিয়েছিলেন। যার বাক্যের শব্দের মাঝে কোনো স্পেস নেই—টানা লেখা। কথা হয় ২০২২ সালে প্রকাশিত তাঁর বই ‘আমার কিছু লেখালেখি’ এবং তাঁর সম্পাদিত ‘স্মরণ ৫২’ নিয়ে। ‘স্মরণ ৫২’-তে তিনি শরীয়তপুর জেলার ভাষা সংগ্রামীদের ছবি, জন্ম-মৃত্যুর তারিখ ও ঠিকানা তুলে ধরেন। পাশাপাশি চৌষট্টি জেলার ভাষা সংগ্রামের অপ্রাকিত বিভিন্ন উল্লেখযোগ্য তথ্য‘স্মরণ ৫২’-তে তুলে এনেছেন। অপরদিকে ‘আমার কিছু লেখালেখি’তে ভাষা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ, বাংলা এবং বাংলা ভাষার উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশের ইতিহাস, শরীয়তপুরের কীর্তিমান ফুটবলার, সাহিত্যিক আবু ইসহাক, রথীন্দ্রকান্ত ঘটক চৌধুরী এবং শিক্ষা বিষয়ক বিভিন্ন তথ্য ও তত্বমূলক গুরুত্বপূর্ণ কিছু প্রবন্ধ রচনা করেছেন। এছাড়ও আরো কিছু গুরুত্বপূর্ণ রচনার পাণ্ডুলিপি রেডি করেছেন—যা শিঘ্রই প্রকাশের কথা জানিয়েছিলেন আমাকে। আশা করব স্যারে পরিবারের লোকজন স্যারের অপ্রকাশিত রচনা ও সংস্কৃত পাণ্ডুলিপি সংরক্ষণ করবেন এবং অপ্রকাশিত রচনাসমূহ প্রকাশের উদ্যোগ নিবে।
জালাল স্যার বয়সের কারণে কালেক্টরেট স্কুলের দায়িত্ব ছেড়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু মানুষ গড়ার এই অদম্য কারিগর জ্ঞান বিলানোর দায়িত্ব ছেড়ে দেননি! বাসার কাছের কোচিংটা চালিয়ে যাচ্ছিলেন। অপরদিকে আমিও নতুন স্কুলের শিক্ষকতা ছেড়ে একাধিক চাকুরি করে অবশেষে এক যায়গায় থিতু হয়েছি। অনেক দিন গ্যাপ হয়ে যাওয়ায়—স্যারের সাথে দেখা হলে নতুন করে পরিচয় দিতে হতো। চোখে ভালো দেখতেন না। স্মৃতিও কিছুটা লোপ পেয়েছিল হয়তো। এবারের একুশে বইমেলায় শরীয়তপুর শিল্পকলা মাঠে জালাল স্যারের সাথে আমার সর্বশেষ কথা হলে বারাবরের মতো স্যার আমাকে তাঁর কোচিং সেন্টারে যেতে বলেছিল। মনে মনে ভেবেছিলাম এবার আর আলসেমি করব না শিঘ্রই যাব। শরীয়তপুরের মুক্তিযুদ্ধ এবং রথীন্দ্রকান্ত ঘটক চৌধুরীর সম্পর্কে কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য সংগ্রহ করব। কিন্তু শরীয়তপুর থেকে আমার অন্যত্র বদলি হওয়ায়, আর যাওয়া হলো না। এর আগেই স্যার গত ২৩ মার্চ ২০২৫ খ্রি: পরিবার-পরিজন, অসংখ্য ছাত্র এবং শুভাকাঙ্ক্ষী ছেড়ে চলে গেলেন না ফেরার দেশে। তাঁর আত্মার শান্তি ও মাগফিরাত কামনা করছি।