ভুল বাতাস :: এম আর মিজান

ভুল বাতাস 

এম আর মিজান

 ভুল বাতাস :: এম আর মিজান

এ এলাকায় মসজিদ থাকলেও কোনো মাদ্রাসা ছিল না। মসজিদ ভিত্তিক আরবি শিক্ষাই ছিল ইসলামি শিক্ষার একমাত্র মাধ্যম। এলাকার ধর্মপ্রাণ মানুষেরা সন্তানদের সেই শিক্ষার জন্য দূর দূরান্তের মাদ্রাসায় ভর্তি করান। তাতে প্রধানত অসুবিধা হয়, এতদূরের পথে শিশুরা যেতে অনিহা করে, দূরের পথে ভয়ও কিছু আছে। মা-বাবা শংকিত থাকেন। অবস্থাসম্পন্নরা বাচ্চাদের আবাসিক ব্যবস্থা করেন। শ্রমজীবী আর দরিদ্রশ্রেণির মানুষের পক্ষে সেটা হয়ে ওঠে না। অথচ তাদের ইচ্ছা করে তাদের সন্তানরা দ্বীনের শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে যেন পরকালে তাদের উত্তরণের উপায় হয়। মহান রবের কাছে যেন ক্ষমা পাওয়ার আর্জি জানাতে পারেন এই বলে যে, ‘ইয়া রব আমরা তোমার কিতাব জানতে শিখতে পারিনি, মানতেও পারিনি যথার্থ জ্ঞানের অভাবে। কষ্ট আর দারিদ্রতা সয়ে তবু সন্তানদের তোমার কিতাব শিক্ষা দিয়েছি, তোমার হুকুম পালণে শিক্ষা দিয়েছি। আমাদের অন্তত সেই উছিলায় তোমার ক্ষমা নসিব কর!’

আলেম ওলামা দু চারজন আছে এলাকাতে। স্থানীয় ছাড়াও দূর দূরান্ত থেকে আগত আলেমও রয়েছে বিভিন্ন মসজিদের খেদমতে। দ্বীনের শিক্ষার সাথে ইমানি বিশ্বাসের গভীরতার সম্পর্ক থাকার কথা থাকলেও দ্বীনের বিস্তার আর প্রতিষ্ঠায় সাধারণ মানুষই এগিয়ে এসেছে। এখানেও তাই হয়েছে। স্থানীয় কলেজের প্রফেসর ফখরুদ্দিনের উদ্যোগে জামে মসজিদের সাথেই স্থাপিত হলো ইকরা কাওমি মাদ্রাসা। সেই থেকে এলাকাতে ধর্মীয় শিক্ষার নতুন মাত্রা যোগ হয়েছে। শ্রমজীবী আর দরিদ্র শ্রেণির মানুষ তো বটেই, সামর্থ্যবানরাও তাদের সন্তানদের দূরের মাদ্রাসা থেকে এনে এলাকায় ভর্তি করিয়েছে। সবার সহযোগিতা আর আগ্রহে কওমি মাদ্রাসাটি খুব দ্রুতই সরগরম হয়ে উঠেছে। অভিভাবকরা নিজেরাই সন্তানদের দিয়ে যায়। যখনতখন এসে একটু দেখে যায়। প্রথমে মক্তব, তারপরেই মাদ্রাসার কার্যক্রম। বাচ্চাদেরকে ভালো মানুষ করার চেষ্টায় যেন কারো কমতি নেই।  অনেক মা বাচ্চাদের জন্য পছন্দসই খাবার নিয়ে আসেন। বাদ যায় না শিক্ষকরাও। শিক্ষকদের জন্যও মাঝেমধ্যে আসে নানা রকম মুখরোচক খাবার। নিয়মানুবর্তিতার নানা শিক্ষার সাথে শিক্ষা দেয়া হয় সময়মত নামাজ আদায়। নামাজের সময় যেখানে আগে গুটিকয়েক মানুষ হতো, এখন সেখানে পুরো মসজিদটি কানায় কানায় পরিপূর্ণ যেন। আশেপাশে বাচ্চাদের কলরব। পুরো এলাকায় যেন নতুন প্রাণের সঞ্চার। নামাজির সংখ্যাও বেড়েছে ধারনাতীত। নিজ সন্তানদের আলেম বানানোর জন্য যেসকল বাবা ভর্তি করিয়েছেন তার সন্তানকে, সেও এখন বিবেকের তাড়নায় অথবা লজ্জাবোধ থেকে মসজিদ এবং নামাজমুখী হচ্ছেন। শুক্রবারে দানবাক্সগুলোতেও দানের পরিমাণ বৃদ্ধি পাচ্ছে।  মসজিদ, মাদ্রাসায় ব্যাপক উন্নয়ন দরকার। এসব উন্নয়ন বেশিরভাগ হয়ে থাকে এসকল দানের টাকায়। রাষ্ট্র কর্তৃক সাহায্য শুধু প্রতিষ্ঠিত প্রতিষ্ঠানের জন্যই হয়ে থাকে যদিও সেই সাহায্য প্রতিষ্ঠিত হওয়ার জন্যই প্রয়োজন। প্রতিষ্ঠিত প্রতিষ্ঠানের রাষ্ট্র কর্তৃক সাহায্য কেন? যে পরিমাণ সাহায্য পাওয়া যাচ্ছে তা প্রয়োজনের তুলনায় নিতান্তই অপ্রতুল বটে। তাই খতিব ও তার সহযোগী অধ্যাপক মিলে নানা উদ্যোগের কথা ভাবে।

শিশুদের কায়িকশ্রমের দরকার আছে। ছোটবেলা থেকেই সে শিক্ষা দরকার। পড়ালেখার পাশাপাশি তাই ছোট ছোট কাজ করানো মূলত শিক্ষারই একটা অংশ। ঠোঁটে সামান্য হাসি নিয়ে আরবি অধ্যাপক জিজ্ঞাসিত একজনকে উত্তর দিলেন। এতিমখানা ও আবাসিক মাদ্রাসাগুলোতে অবশ্য শিক্ষার্থীদের নিজ হাতে প্রায় সব কাজই করতে হয়। নিজেদের জামাকাপড় ধোয়া, শিক্ষকদের জামাকাপড় ধুইয়ে দেয়া, মসজিদ, মাদ্রাসা, থাকার জায়গা, নিজেদের বিছানাপত্তর, খাবার খাওয়ার তৈজসপত্র পরিস্কার এমনকি নিজেদের রান্নাও নিজেদের সহযোগিতায় তারা করে থাকে। একে অন্যের চুল পর্যন্ত এরা কাটে। শিক্ষদের নানা ফাই ফরমাসসহ বাজারঘাটও করতে শিখানো হয়।  শিক্ষক নিজেই কাদা মাটি কেটে কেটে বলবাটিতে তুলে দিচ্ছেন। বর্ষার পানি নেমে যাওয়াতে পাশের খালের কাদামাটি এনে মাদ্রাসার নিচু খাদ, পাশের ভাঙ্গা রাস্তাটিও মেরামতের নিমিত্তে তার এই উদ্যোগ ভালো বটে। তবে কাদা মাটির ওজন হয়তো তার আন্দাজের বাইরেই ছিল। ছোট ছোট কাজ শিশুরা করবে, শিখবে সে মন্দ নয়। তবে সেটা পর্যায়ক্রমে শিখাই উত্তম। উপর্যুপরি কয়েকদিন চললো মাটি কাটার কাজ। অনেক খানাখন্দ ভরাট হয়েছে।  আরো বেশ কিছু বাকিও রয়েছে। একে একে কয়েকজন শিশু অসুস্থ হয়ে পড়েছে। প্রকৃত সংখ্যা তখন পর্যন্ত অধ্যাপকের কাছে ধরাই পড়লো না, যতক্ষণ না কলেজের প্রফেসর ফখরুদ্দিন সাহেব তাকে অবহিত করলেন। রিক্সা চালক, দিনমজুর করে সন্তানকে মাদ্রাসা দিয়েছেন এই বড় সাহসের ব্যাপার। বাচ্চাদের দিয়ে এই কসরত না করানোর কথা বলার সাহস তাদের নাই। প্রফেসর ফখরুদ্দিনকে সমীহ করেন সবাই। অভয় নিয়ে কথা বলেন। স্যার যদি মাদ্রাসায় কোন সাহায্য লাগে, দরকার হলে যেন হুজুর আমাদেরকে ডাকে। আমরা দরকার হলে দুয়েক দিন কাজ করে দিলাম। ফখরুদ্দিন সাহেব বুঝতে পারেন তাদের দরদ। আসলেই তো। শিশুরা তো টানা কসরত করতে পারে না। উপরন্তু প্রায় অভিভাবকই বিষয়টা নিয়ে মনক্ষুন্ন হয়েছে। প্রায় প্রতিটি শিশুকেই ফখরুদ্দিন সাহেব ঘুরে ঘুরে খোঁজ নিয়েছেন। সবার একই উপসর্গ। শরীরের পেশীতে ব্যথা। সমস্যা আহামরি না। কাচা শরীরে হঠাৎ কসরতে এমনটা হওয়াটা স্বাভাবিক। জোয়ানদেরও হঠাৎ কসরতে এমনটা হয়। ধীরে ধীরে অভ্যাস হয়।

বাজারেই ফখরুদ্দিন সাহেবের কাপড়ের দোকান। দোকান বলা চলে না বৈকি! কিছু বিছিন্ন কাপড় গ্লাস করা রেকে খাপছাড়া পড়ে আছে। পাঞ্জাবির কাপড়, পুরুষের কিছু জামার গজ কাপড়, লুঙ্গি, গামছা, দু চারটা কাপড়। প্রফেসর মানুষ। কলেজ ছুটির পর অবসর সময়ে বসেন। সময় কাটান। এলাকার মুরুব্বি গোছের লোকেরা এসে বসে গল্পগুজব করে সময় পার করার একটা মাধ্যম হিসেবেই বেশি উপযুক্ত। বেচা বিক্রি দুয়েকটা হলে হলো, না হলে নাই। সংসারের খরচ তো আর চালাতে হয় না, তাই দুশ্চিন্তাও নেই। অনেকের মতো প্রাইভেট, কোচিং বাণিজ্য তার অপছন্দের কাজ। তার স্বচ্ছ ধারণা এতে না চাইলেও অস্বচ্ছতা থাকে। শিক্ষার্থীদের পাঠে অংশগ্রহণ পরিপূর্ণ হয় না। ছাত্র শিক্ষক উভয় পক্ষেই দূর্বলতা থাকে। পরে শিখাবো আর পরে শিখবো। এই দোকান থেকে পয়সাকড়ি আসুক না আসুক, গ্রামের মানুষের সাথে দু’দণ্ড কথা বলা হয়। সবাইকে কাছেও পাওয়া যায়। সেখানেই অন্যান্য দিনের মতো মাদ্রাসার অধ্যাপক এলে ফখরুদ্দিন সাহেব কথাটা তুললেন। ‘হুজুর আসসালামু আলাইকুম।’ হুজুর সালামের জবাব দিতে দিতে সামনের বেঞ্চিতে বসলেন। ফখরুদ্দিন সাহেব পাশের দোকানটায় আরো এক কাপ চা দিতে বললেন, ‘হুজুর একটা বিষয় লক্ষ্য করেছেন কিনা জানি না, মাদ্রাসার বেশ কিছু বাচ্চা অসুস্থ। আমি কয়েকজনকে দেখতে গিয়েছিলাম। কথা বলে যেটা জানলাম সবারই শরীর ব্যথা। হয়তো কাচা শরীরে হঠাৎ কসরত পড়াতে এই অসুস্থতা। অনেকের অভিভাবক এসে স্বশরীরে আমাকে জানিয়েছেন। তারা নিজেরা সাহায্য করতে প্রস্তুত আছে যদি আপনারা তাদের কাছে সাহায্যের আর্জি জানান। বাচ্চাদের এতটা পরিশ্রমে তারাও ব্যথিত। বোঝেনই তো খেটে খাওয়া মানুষ, বড় কষ্ট সয়ে সন্তানদের একটু আদর-স্নেহে রাখতে চান। সেই সন্তানরা অসুস্থ হলে বড় রকমের ভাঙ্গা ভেঙে পড়েন। সাথে অর্থকষ্ট তো থাকেই ‘ ফখরুদ্দিন সাহেবের কথা শেষ হতেই অধ্যাপক সাহেব যেন নিজের নিয়ন্ত্রণ হারালেন। ‘আপনি কি বলতে চান দ্বীনের খেদমতে আমি বাচ্চাদের কাজ করিয়ে অন্যায় করেছি? এটা তো স্পষ্ট ইসলাম বিদ্বেষ। আর ইসলামের বিদ্বেষ কোনো ইমানদার করলে তার স্ত্রী তালাক হয়ে যায় আপনি জানেন?’ ফখরুদ্দিন সাহেব অপ্রস্তুত হয়ে গেলেন। কি বলবেন ভেবে পাচ্ছেন না। আশেপাশের মানুষ জনেরা তাকিয়ে আছে। তার দোকানেও এলাকার বেশ কিছু মানুষ হা করে তাকিয়ে আছে। তিনি এদিক ওদিক তাকিয়ে যেন আরো লজ্জিত হলেন। এহেন পরিস্থিতিতে কি বলা উচিত তাও তিনি বুঝতে পারছেন না। জবাবের প্রতি উত্তর কিরুপ হবে তাও একবার ভাবলেন মনে মনে। ‘আসলে হুজুর আমি বিরুদ্ধাচারণ তো করছি না। উপরন্তু অভিভাবকরা মাদ্রাসার উন্নয়নের জন্য স্বেচ্ছায় শ্রম দিতে চায় নিজেদের সন্তানদের জায়গা থেকে, তাতে তো দোষনীয় না। আপনি বাচ্চাদের দিয়ে অমন পরিশ্রম করিয়েছেন। বাচ্চাগুলো অসুস্থ্য হয়ে পড়েছে। তাদের দিয়ে কাজ না করতে বলাতে আমার স্ত্রী তালাক হয়ে যাবে? এ কেমন কথা!’

‘এমনই কথা। দ্বীনের কোনো কাজে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ বাধা কোনো ইমানদারের তরফ থেকে হলে এর চেয়ে কড়া কথা হাদিসে বলা আছে।’ অধ্যাপক দাঁড়িয়ে গেলেন কথা বলতে বলতে। চা চলে এলেও চা আর তিনি পান করলেন না। ফখরুদ্দিন সাহেবের মেজাজটা বিক্ষিপ্ত হয়ে গেলো। গল্প গুজবে আর প্রাণ পেলেন না। লোকেরাও যার যার মতো একে একে চলে গেলেন। বাজারের মসজিদে মাগরিবের নামাজ পড়ে তিনি বাড়ির দিকে রওনা করলেন।

ঘরে ঢুকতেই তিনি লক্ষ্য করলেন স্ত্রী ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাঁদছে। ফখরুদ্দিন সাহেব ব্যথিত হবার চেয়ে অবাক হলেন বেশি। তার স্ত্রী সহজ মানুষ। তাকে প্রচণ্ড ভালোবাসেন। তার কাঁন্নার সহজ কোনো বিষয় খুঁজে পেলেন না মনের মধ্যে, অনেক খোঁজাখুঁজির পরেও। শ্বশুর বাড়িতে কোন খারাপ কিছু হয়েছে কিনা কে জানে? তেমন কিছু হলে তার কাছেও খবর আসতো আগে। শরীর খারাপ বা অসুখ বিসুখ হলেও আগে পরে তার আলামত শোনা যেতো। ‘কি হয়েছে রাবেয়া, কাঁন্না করতেছো কেন ‘ প্রশ্ন শুনে এবার কাঁন্না শব্দ পেলো। ‘আমাকে নাকি তুমি তালাক দিয়েছো? আমার কি এমন মহা অন্যায় যে বাজারে বসে তালাক দিতে হলো? এত বিরক্ত আমার উপরে কখনো তো বুঝতে দাওনি!’ বলেই সে আবার ফুপিয়ে উঠলো। ফখরুদ্দিন সাহেব হেসে ফেললেন। ‘কে বলেছে তোমাকে এই কথা?’ ‘বলার মানুষের অভাব আছে নাকি? গ্রামের সবাই জানে। তারাই বলেছে। এখন বাকি তোমার মুখে শোনা। তুমি বলো এবার।’ প্রচন্ড অভিমানে কথাগুলো বলে সে সামনে থেকে চলে গেলো। ফখরুদ্দিন সাহেব মনে খুবই বিরক্ত বোধ করলেন। হুজুর কি তাইলে বলেছে? নাকি যারা আশেপাশে ছিল তারাই পুরো গ্রাম করেছে। মানুষ রটনা এতো দ্রুত এবং আগ্রহ নিয়ে করে যে, অন্য কোন কাজ এতো আগ্রহ নিয়ে করে না। অথচ ওখানে যারা উপস্থিত ছিল সবার সাথেই তার ভালো সখ্যতা। হযরত আয়েশা(রা) এর নামে একবার তারই সহগামীরা মক্কায় ফিরে এমন এক রটনা রটিয়ে দিলো যে তা বাতাসের ন্যায় দ্রুত সারা মক্কায় ছড়িয়ে পড়লো। বিকেলের একটা কথা, সেটা সন্ধ্যা না হতেই পুরো গ্রাম ছেয়ে গেছে। এমনকি আমার স্ত্রীকেও এসে সে খবর দেয়া হয়ে গেছে। মানুষ এমন কেন? নাহ, ফখরুদ্দিন সাহেব আর ভাবতে পারলেন না কিছু।  পৌরসভার খতিবকে বিষয়টা জানানো দরকার। এই মাসআলা ক্লিয়ার করতে হবে। এভাবেই মানুষের মুখে মুখে ভুল চলতে থাকে এবং তা সত্যের ন্যায় মানুষ মানতে শুরু করে। ধর্মের সঠিক প্র্যাকটিসই কেবল বহু স্রষ্টায় বিশ্বাসীদের এবং অন্যান্য ধর্মীয় আচার থেকে ইসলামকে উন্নত হিসেবে প্রমাণ করতে পারে।

পৌরসভার খতিব এসেছেন। ঘরোয়া পরিবেশেই আলাপ হওয়া উচিত। খতিব সাহেব নঈমুল সিদ্দিকী বাজারে বসতে চেয়েছিলেন। ফখরুদ্দিন সাহেব বললেন, ‘ভাই সাহেব ক’জনের সামনের আলোচনা পুরো এক পাড়া হয়ে গেছে, যদি বাজারে এ নিয়ে আলোচনা হয় না জানি আশেপাশের আরো কত পাড়া এ নিয়ে আলোচনা ছড়াবে। ভালোটা তো মানুষ ছড়াবে না। দেখা গেলো কেউ জানলো এই আলোচনার কারণ কি? কলেজের প্রফেসরের বউ ছাড়াছাড়ির মিমাংসা নিয়ে বৈঠক হচ্ছে একটু অংশ নিয়ে দেখবেন আলোচনা ছড়াবে। আসল ঘটনা থাকবে চাপা পড়ে ‘ নঈমুল সিদ্দিকী তার যুক্তিতে হা মিলালেন। কথা ঠিকই বলেছে সে। নঈমুল সিদ্দিকীর সাথে আরো কয়েকজন আলেম এসেছেন। তিনিই সাথে এনেছেন। একই গোছের মানুষ সবাই। নঈমুল সিদ্দিকী নিজেই মাদ্রাসার প্রিন্সিপাল এবং অধ্যাপককে ডাকলেন। সেদিন উপস্থিত দুয়েকজনকেও ডাকানো হয়েছে। ফখরুদ্দিন সাহেব ঘরোয়া আয়োজনে ভালো খাবার দাবারের আয়োজনও করেছেন। মানুষ খাওনো তার জন্য পূণ্যের কাজ। আর আলেম ওলামাতো বিশেষ সম্মানিত রাসুল (স) নিজে বলেছেন।

ফখরুদ্দিন সাহেব বিশেষ কারণ ছাড়াও আলেম ওলামাদের সমাদর করেন। শুধু যে আলেম ওলামা তা নয়, এলাকার অনেক শ্রমজীবী মানুষও তার বাসায় মেহমান হন প্রায়ই। খাওয়া দাওয়া শেষে খতিব সাহেব মাদ্রাসার অধ্যাপককে উদ্দেশ্য করে রসিকতার সুরে বললেন, ‘খাবার তো মাশা আল্লাহ দারুণ হয়েছে, কি বলেন অধ্যাপক সাহেব?’ অধ্যাপক হা তে হা মিলিয়ে বললেন, ‘আলহামদুলিল্লাহ, সত্যি ভালো হয়েছে।’ ‘কিন্তু হুজুর খাবার তো রান্না করছে তালাক হয়ে যাওয়া ফখরুদ্দিন সাহেবের স্ত্রী।’ এটা বলার সাথে সাথে অন্যান্য সবাই স্ব জোরে হেসে উঠলেন। অধ্যাপক সাহেব হাসলেন না। তিনি হয়তো বুঝতে পারছেন। আজকের এই অতিথি ভোজের তাহলে উদ্দেশ্য আছে। খতিব সাহেবই প্রথম মূল আলোচনা শুরু করলেন। অধ্যাপক সাহেব জানেন এলাকাতে যে একটা বাতাস বইছে? যে বাতাসে একটা পরিবারের এতো বছরের সাজানো গোছানো সংসারে টালমাটাল পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। সবচেয়ে বড় যেই ক্ষতিটা এই বাতাসে হয়েছে সেটা হচ্ছে ফখরুদ্দিন সাহেবের সম্মান ক্ষুন্ন হওয়া। ভদ্রলোক কারো মুখের দিকে তাকাতে সংকোচ বোধ করছেন এই রটনার দরুণ। আর রটনার কারণটা হচ্ছে আপনার উক্তি। এখন আপনি কি আপনার উক্তিটা সম্পর্কে আমাদের একটু বিস্তারিত বলবেন যাতে করে উপস্তিত সবার মাধ্যমে বহমান ভুল বাতাসটা শুদ্ধ হতে পারে? দেখেন আমাদের জানাশোনার ঘাটতি থাকতেই পারে। অনেক সময় জানা বিষয়ও বলার কৌশল এবং প্রেক্ষাপটের কারণে সেটা ভিন্ন হয়ে থাকে। আমাদের বিষয়টা জানা হলো যদি আমাদের এ ব্যাপারে কোন অস্পষ্টতা থাকে। সবচেয়ে বড় ব্যাপার হলো ইসলামের কোন ফতোয়ার নামে যদি সমাজে ভুল শিক্ষা বা ম্যাসেজ ছড়ায় সেটা না ইসলামের চেয়েও ভয়াবহ। আপনি কি বলেছেন দ্বীনি কাজে অসহযোগিতা বা অসহযোগিতামুলক সম্মতিতে স্ত্রী তালাক হয়ে গেছে? অধ্যাপক সাহেব মাথা নিচু করে আছেন। কি বলবেন তিনি ভেবে পাচ্ছেন না। তার চোখে মুখে কিছুটা অসহায়ত্বের ছাপ পরিলক্ষিত হচ্ছে। নঈমুল সিদ্দিকী নিজেই কথা বললেন, দেখেন আমিও একজন আলেম। আপনিও আলেম। আমরা যেন ধর্মীয় জ্ঞান আর বিশ্বাসকে যেমন তেমন করে ব্যবহার না করি। নিজেকে সঠিক প্রমাণ করতে গিয়ে যেন ধর্মকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার না করি। কারো কোন পাপ, আল্লাহর অবাধ্যতা বা অন্য যে কোনো গুনাহের সাথেই স্ত্রী তালাকের কোন সম্পর্ক নাই। প্রতিটা গুনাহ, অবাধ্যতার জন্য তার নির্ধারিত ফলাফল রয়েছে। একটির সাথে অন্যটির সম্পর্ক নেই। স্ত্রী তালাক দিলে সেটা তালাকের সাথেই সম্পর্কিত, অন্য কোনো পাপের সাথে নয়। আবার অন্য কোনো পাপ করলে স্ত্রী তালাকের প্রশ্ন থাকতে পারে না। আপনি কোন যুক্তিতে এহেন একটা কথা বাজারের মধ্যে বলে দিলেন আমাদের বোধগম্য না। আপনার জ্ঞাতার্থে আমি আরেকটু সংযোজন করছি আমাদের দেশে প্রচলিত একটা কথা আছে যেটা হাদিসের নামে চলে, তা হলো পরপর তিনটি জুম্মা কেউ আদায় না করলে তার স্ত্রী তালাকের গোনাহ হয়! আবার অনেকে মনে করে তালাকই হয়ে যাবে!’ যদি এমন ভ্রান্ত ধারণার বশবর্তী কোনো কারণে এহেন উক্তি এসে থাকে তবে তওবা করা উচিত। ইসলাম প্রতিটা ভালো কাজ এবং মন্ধ কাজ সুনির্দিষ্ট করে দিয়েছে। সুতরাং এখানে অতিরঞ্জিত করার সুযোগ সয়ং খোদ রাসুলকেও দেয়া হয়নি, আর আমরা কি ছাড়? ইসলামে এমন অনেক আচরণ, বিধি প্রচলিত আছে যেগুলোর গোড়াপত্তন কোননা কোনো আলেম অথবা আলেম শ্রেণির মানুষের দ্বারাই প্রচলিত হয়েছে। যেমনটা আপনার কথায় সেদিন হলো। এলাকার মানুষ হয়তো ভিন্নভাবে সেটা প্রকাশ করেছে কিন্তু সূচনা ছিল আপনার মুখ নিসৃত উক্তি। এখানে তাদের সবাই রয়েছে। অন্তত সঠিক বিষয়টা সবাই জানুক, বলুন আপনি। অধ্যাপক সাহেব চোখ থেকে জল ছেড়ে দিলেন। ফখরুদ্দিন সাহেবের হাত ধরে তিনি কেঁদে ফেললেন। ভাই, আসলে মুখ থেকে সেদিন কথাটা বেড়িয়ে গেছে। বেরুনো কথা ফেরানো যায় না। আমিও পারিনি। তাই নিজের কথার উপরই থেকেছি। আমাকে ক্ষমা করে দিন। উপস্থিত সবার কাছে আমি ক্ষমা চাইছি এহেন ভ্রান্ত উক্তির জন্য। কোরআন হাদিসের কোথাও এমন কোন কথা নেই। দয়া করে আমার উক্তিকে অগ্রাহ্য করবেন এবং যে ভুল তথ্য ছড়িয়ে পড়েছে তার বিপক্ষে সত্য এবং সঠিকটা জানাবেন। নঈমুল সিদ্দিকী সবার উদ্দেশ্যে দ্বিতীয়বার একই কথার পুনরাবৃত্তি করে নিশ্চিত করলেন, ‘আপনারা সবাই বুঝতে পেরেছেন? আসলে কোরআন হাদিসে এমন কোন কথা বলা হয়নি যে, অমুক কাজ করলে স্ত্রী তালাক হয়ে যাবে। এটা নিয়ে কেউ ভুল ছড়াবেন না। সত্য সঠিক যাছাই করে তবেই সেটা অন্যের কাছে বলবেন। আর অন্যের মান সম্মান জড়িত কোন হালাল বিষয়েও কানাকানি থেকে বিরত থাকবেন।’

Post a Comment (0)
Previous Post Next Post