গল্প ।। পাগল ।। সুলতান মাহমুদ
অফিসে খুব ব্যস্ততার মধ্যে আছি। কাল মাসিক মিটিং। এদিকে সকাল থেকে
কম্পিউটারটা নষ্ট। ফটোস্ট্যাট মেশিনতো থেকেও নেই। কিন্তু এসব অজুহাত দিয়ে কাজ বন্ধ
রাখার উপায় নেই। কিছুক্ষণ আগে কম্পিউটার ঠিক করানো হয়েছে। হন্তদন্ত করে কোনো রকম
রেজুলেশনটা প্রিন্ট আউট করলাম। এখনই স্যারকে দেখিয়ে একবার কারেকশন করে নিতে হবে। রেজুলেশন
গুছিয়ে মে আই কাম ইন স্যার বলে অনুমতির অপেক্ষা না করেই স্যারের রুমে প্রবেশ
করলাম। কিন্তু স্যার কোথায়? চেয়ারে তের চৌদ্দ বছর বয়সের একটা ছেলে বসে আছে! কিছুটা
ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলাম। এই ছেলে তুমি এখানে কেন?
-হে হে হে!
ছেলেটির দাঁতগুলো হলদেটে। বোঝা যাচ্ছে অনেকদিন দাঁত মাজে না। গায়ে
একটা নেভিব্লু সার্ট। পরনে হাফ প্যান্ট। পায়ে কোন স্যান্ডেল নেই।
-কি বলছি আমার কথা কানে যায় না? তুমি এখানে ঢুকলে কী করে?
-হে হে হে!
-ভারী বিপদতো! কে তুমি?
-হে হে হে! আমি স্যার!
বলে কি? আমার ভিরমি খাওয়ার যোগাড়।
-তুমি এখানে কী করে ঢুকলে?
-হে হে হে! আমি চাকরি পাইছি। আমার বেতন কই? পাঁচটা টাহা দেন।
এতো দেখছি আস্ত পাগল (আমি বিড় বিড় করে বল্লাম)। কালু, ঐ কালু। আমি
উচ্চস্বরে ডাকলাম। হন্তদন্দ হয়ে কালুর প্রবেশ।
-এই ছেলে এখানে ঢুকল কী করে? (কিছুটা রাগতস্বরে)
কালু ছেলেটার দিকে তাকিয়ে ভয়ানক ক্ষেপে গেল।
-স্যার এই হালায় তো পাগল।
-পাগল!!
-হ স্যার। এই হালারপো চেয়ারতন উঠ নাইলে পিডাই হাড্ডিগুড্ডি সব
ভাইঙা দিমু।
-হে হে হে। উঠুমনা!
-হালারপো হালা, এত বড় সাহস, স্যারের চেয়ারে বইছস আবার কছ উডুম না।
খারা তোর পাগলামী ছুডাইতাছি।
কালু ধপাধপ ছেলেটির পিঠে নির্দয়ভাবে কয়েকটা কিল ঘুষি দিয়ে টেনে
হিচঁড়ে চেয়ার থেকে নামিয়ে বাইরে নিয়ে গেল। যন্ত্রণায় ছেলেটি কাঁদছিল। আমি তাড়াতাড়ি
ফাইলগুলো টেবিলে সাজিয়ে রাখলাম। এরপর থেকে ছেলেটাকে প্রায়ই দেখতাম। কোর্টের
বারান্দায়, রাস্তায়, দোকানে, হোটেলের সামনে। একদিন দেখলাম রাস্তার মাঝখানে দাঁড়িয়ে
নাচ দেখাচ্ছে। তার নাচ দেখে দর্শকরা খুব আমোদিত। অনেকে হাত তালি দিচ্ছে। ছেলেটার
মুখ দিয়ে বেশিরভাগ সময় লোল পড়ে। গেঞ্জির সামনের দিকটা ভিজে থাকে প্রায়ই। একদিন
দেখি আবার গান গাইছে—‘সোনা বন্ধু তুই আমারে করলি যে দিওয়ানা, মনে তো
মানে না, দিলেতো বুঝে না।’
আমি জিজ্ঞেস করলাম—‘কিরে তুই স্কুলে যাস না?’
-আমিতো সব পারি
-কী পারছ?
-এগারো এগারো বাইশ, আমগো বাইত্তে যাইস, কুত্তা মড়া ভাইজ্জা দিলে
কড়কড়াইয়া খাইস।
-এগুলোতো পঁচা কথা।
-আমি নামতাও পারি।
-চৌরারার ঘরের নামতা।
-কিরকম?
-চৌরা একে চৌরা, তিন চৌরা মাউরা, চার চৌউরা ঘাউরা।
-এটাতো আরও বাজে কথা।
-হে হে হে। আমি আরও জানি।
-আর কী জানিস?
-গাছতলা ঘুরিফিরি, যদি একখান চিল দেহি, চিলের পাছায় হালডি মারি।
-এই তোর পড়াশোনা?
-হ স্যার
-আমি আর পড়ুম না, চাকরি করুম, আমারে বেতন দেন। বলেই হাত বাড়িয়ে দেয়।
আমি পাঁচ টাকা দিয়ে বিদায় করি।
একদিন অফিস থেকে বের হতে হতে অনেক রাত হয়ে গেছে। মেইন রোডে এসে
দেখি কোন মানুষ জন নেই। এরমধ্যে সে দেখি একা একা একটা কুকুরের সাথে দৌড়াদৌড়ি
করছে।
-কী-রে বাড়ি যাবি না?
-নাহ
-কেন?
-অহন গেলে মায় মারব।
-মারব না, তুই যা।
-হে হে হে আপনেরে মায় পাডাইছে না। বলেই সে দৌড়ে চলে যায়।
আরেক দিন কলেজ মসজিদে মাগরিবের নামাজ পড়ে বের হচ্ছি। দেখলাম একজন
সম্ভ্রান্ত লোক কিছুটা অন্ধকারে পাগলটাকে ডাকছে।
-বাড়িত চল বাপ।
-না না তুমি যাও। বলেই সে দৌড় দেয়। লোকটি অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে
আছে।
আমি লোকটি বললাম—‘এটা কে?’
-আমার পোলা।
-আপনি কি করেন?
-আমার বাজারে চাউলের আড়ত।
-আপনার অবস্থাতো ভালোই। ছেলের চিকিৎসা করান নাই?
-করছি ভাই। ছোট বেলাতনই পাগলামি স্বভাব। অনেক ডাক্তার দেখাইছি। কোন
কাম হয়নাই। দিন দিন অর পাগলামি বাড়তাছে। আমার একটাই পোলা। চেষ্টার ত্রুটি করিনাই
কিন্তু কোন লাভ হয়নাই। দোয়া কইরেন আমার পোলাডার লইগ্যা।
আচ্ছা। আমার ছোট্ট জবাব।
https://www.krittinasharkabbo.com/2025/07/blog-post_24.html