শরীয়তপুরের সাহিত্যে নদী ।। ইয়াসিন আযীয

শরীয়তপুরের সাহিত্যে নদী

ইয়াসিন আযীয

শরীয়তপুরের সাহিত্যে নদী ।।  ইয়াসিন আযীয

নদীমাতৃক বাংলাদেশের শরীয়তপুরকে যদি একটি নদীমাতৃক জেলা বলিতবে বোধ করি ভুল হবে না। এই জেলার তিন দিক দিয়ে বয়ে চলেছে: পদ্মা, মেঘনা ও আড়িয়াল খাঁ’র মতো দেশের প্রধান তিনটি নদী। জেলার একেবারে মাঝখান দিয়ে সর্পিল আকারে বয়ে গেছে রাজা রাজবল্লভের কীর্তিনাশকারী ‘কীর্তিনাশা’। এসবের বর্ণনা মেলে এ জেলার কবিদের কবিতায়—‘আমার বাড়ি শরীয়তপুর পদ্মা নদীর পাড়/মাঝখান দিয়ে বইছে ধারা কীর্তিনাশা তার’ (শরীয়তপুর ও কীর্তিনাশার গীতিকবিতা-খান মেহেদী মিজান)পদ্মার ঢেউয়ে ভেজা দোয়েলের ভোর/কীর্তিনাশার তীর ঘেঁষে রাখালি দুপুর।/সোনালি ভোরের মাঝে খেজুর গুড়/এই নিয়ে আমাদের শরীয়তপুর’ (কবিতা: আমাদের শরীয়তপুর- সুলতান মাহমুদ সজীব) এছাড়াও এই জেলায় রয়েছে স্মৃতি বিজড়িত পালং নদী, রয়েছে দামুদিয়া বা দামোদিনী, জয়ন্তী বা জয়ন্তীয়া ও ভয়রা নদী। এসকল নদীর বয়ে আনা পলি উর্বর করে তোলে শরীয়তপুরের মাটিকে। ফলে সবুজ শ্যামল শস্যে ভরে ওঠে এ অঞ্চল, যা দেখে শরীয়তপুরের শিল্প সাহিত্য পিয়াসীরা গেয়ে ওঠেন গান। ছড়া কাটেন। রচনা করেন গদ্য, পদ্য ও কবিতা। তেমনি একটি কবিতা—‘আমনের ভাত লাউলতা খেয়ে গাঙ্গে করি স্নান/বাঁচিয়ে রেখেছে এই সবুজেরা আমাদের প্রাণ’ (কবিতা: স্মৃতির চড়ুই- রাজু আলীম)কখনো আবার এসব নদী ভেঙে নেয় বাড়িঘর, বাসনা বিলাস। নতুন চর জাগলে নয়া চরের পলি মাটিতে সোনালি ধানের প্রত্যাশায় সুদিনের স্বপ্ন বোনে। কখনো নদীতে ডুবে সলিল সমাধি ঘটে প্রিয়জনের। এই নদীরাই, নদীর এই রূপ-বৈচিত্র্যই এখানকার মানুষের জীবনের আশা-ভরসা, কান্না-হাসি। তাইতো এসবের কোনো কিছুই বাদ যায় না তাঁদের লেখা থেকে। ‘জলের কাব্য ফলের কাব্য মুক্ত বাহু বলের কাব্য/আশার কাব্য ভাষার কাব্য সব কীর্তি নাশের কাব্য/আড়িয়াল খাঁ আর পদ্মার মাঝে ছোট্ট নদী কীর্তিনাশা/এই নদীর জল সেচের কাজে ফসল ফলায় গরিব চাষা’ (শরীয়তপুর ও কীর্তিনাশার গীতিকবিতা- খান মেহেদী মিজান)


লেখকের অন্যান্য প্রান্ধ/নিবন্ধ: কবি মো: ফজলুল হকের কবিতায় ‘কীর্তিনাশা’ ও অন্যান্য ।। রথীন্দ্রকান্ত ঘটক চৌধুরী


বাংলা সাহিত্যের অন্যতম শক্তিমান কথা সাহিত্যিক আবু ইসহাক এর গল্প, উপন্যাসে উঠে এসেছে নদী। বত্রিশটি অধ্যায় সংবলিত তাঁর দ্বিতীয় উপন্যাস ‘পদ্মার পলিদ্বীপ’ ১৯৮৬ সালে প্রকাশিত হয়। এটি একটি আঞ্চলিক উপন্যাস। পদ্মা তীর ভাঙে আবার কিছুদিন পর কিছু দূরে চর জাগে। পদ্মা নদী তীরবর্তী ও চরকেন্দ্রীক মানুষের জীবন সংগ্রাম এবং নতুন জেগে ওঠা চরের দখল নিয়ে দ্বন্দ্বই এই উপন্যাসে মূখ্য। উপন্যাসের ষোলোটি অধ্যায় বাংলা একাডেমি ‘উত্তরাধিকার’ পত্রিকায় ‘মুখর মাটি’ নামে ১৯৭৪ থেকে ১৯৭৬ পর্যন্ত প্রকাশিত হয়েছিল। সাহিত্যবোদ্ধাগণের মতে ‘মুখর মাটি’  নামটি ছিল বহুগুণে সাহিত্যগুণসম্পন্ন এবং প্রতীকী। নতুন নামটি সাদামাটা। আবু ইসহাক এর বিখ্যাত গল্প ‘জোঁক’ ও ‘মহাপতঙ্গ’। ‘দাদীর নদীদর্শন’ নদীকেন্দ্রীক তাঁর আর একটি বিখ্যাত গল্প। গল্পটি শুরু হয়েছে ঠিক এভাবেই ‘নদী যে-দেশের শিরা-উপশিরা, সে-দেশের অনেক মানুষ নদী দেখেনি।’ এই গল্পে যিনি নদী দেখেননি তিনি হলেন রাজাপুরের মীরহাবেলীর মৌলবি দাদি। ষাট বছরের ওপর বয়স দাদির পর্দানিষ্ঠার অনেক কাহিনি উপমা হিসেবে ব্যবহৃত হয়। বাড়ির বাইরে নদী দেখতে যাবেন তো দূরের কথা তিনি পঞ্চাশ বছরের মধ্যে ভুলেও একবার বাড়ির বৈঠকখানায় ঢুকেননি। অবশেষে নদী এসেছে তাঁর সাথে দর্শন দিতে। দু মাইল দূরে ছিল যে পদ্মা, ভাঙতে ভাঙতে সে এখন মীরহাবেলীর কাছাকাছি এসে গেছে। সরীসৃপের মতো বুকে হেঁটে ক্রমেই এগিয়ে আসছে। দুশো বছরের পুরাতন জরাজীর্ণ হাবেলী পদ্মার শোঁ-শোঁ আওয়াজ শুনে কাঁপছে থরথর করে। অবশেষে মীরহাবেলীর লোকজন উত্তরপাড়ে আশ্রয় নেয়। অবশেষে ডাক আসে দাদির। দরজার কাছ থেকে পালকিতে এবং পালকিসমেত পানসিতে ওঠেন দাদি। ভাদ্র মাসের ফুলে ওঠা ধু-ধু পদ্মা, খিড়কির পর্দা ফাঁক করে ঘোলাটে চোখে দেখেন দাদি। ভয় ও বিস্ময় তাঁর চোখেমুখে! আশেপাশে ইলিশমাছ ধরার নৌকা ঢেউয়ে দোল খাচ্ছিল। দোল খাচ্ছিল পানসি। একপর্যায়ে ঢেউয়ের দুলুনিতে বমি করে দেন দাদি। এটাই ছিল দাদির প্রথম ও শেষ নদীদর্শন।


শরীয়তপুরের জাজিরার তরুণ প্রজন্মের জনপ্রিয় উপন্যাসিক রেদোয়ান মাসুদ এর ‘ভাঙন’ উপন্যাস ২০২১ সালে প্রকাশিত হয়। আবু ইসহাক এর ‘পদ্মার পলিদ্বীপ’ উপন্যাসের প্রায় ৩৫ বছর পরে ভাঙন প্রকাশিত হলেও ‘ভাঙন’ উপন্যাসে উঠে এসেছে ‘পদ্মার পলিদ্বীপ’ উপন্যাসের শতাব্দী পূর্বের গল্প। অর্থাৎ শরীয়তপুরের উত্তর পাশ দিয়ে পদ্মা নদীর নতুন গতিপথ সৃষ্টির সময়ের গল্প। প্রায় দুই শত বছর পূর্বে শরীয়তপুর এর পশ্চিম দিক দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল পদ্মা। পদ্মা থেকে রথখোলা খাল ও কালীগঙ্গা নদী মেঘনায় গিয়ে মিশেছিল। হঠাৎ করেই পদ্মার এই দুটি শাখার জলপ্রবাহ বৃদ্ধি পেতে থাকে এবং দু’পাড় ভাঙতে থাকে। এভাবে কয়েক দশকের মধ্যে পদ্মা গতিপথ পুরোপরি পরিবর্তন করে শরীয়তপুরের উত্তর পাশ দিয়ে একক ভাবে প্রবাহিত হয়ে মেঘনায় মিলিত হয়। ফলে পদ্মা ‘ভাঙন’ উপন্যাসের নায়ক নয়ন এবং নায়িকা নন্দিতাকেই শুধু আলাদা করে দেয়নি তাদের হৃদয়ও ভেঙে ছারখার করে দেয়। বারোভূঁইয়াখ্যাত মহাপ্রতাপশালী রাজা চাঁদ রায় ও কেদার রায়ের রাজধানী শ্রীপুরের সকল কীর্তি এবং বিক্রমপুরের আরেক রাজা রাজবল্লভের রাজধানী রাজনগরের সকল কীর্তি, কীর্তিনাশা নাশ করে যেন নামকরণ সার্থক করে।


পদ্মা আশেপাশের হাজার হাজার মানুষের জীবন-জীবিকা হুমকির মুখে ফেলে দিয়েছিল। একজন শিক্ষিত ছেলে নয়ন জীবিকার সংস্থানে জেলে জীবন বেছে নিতে বাধ্য হয়েছিল। অপরদিকে নায়িকা নন্দিতার বাবা ব্যবসা ও জমিজমা হারিয়ে ভূমিহীন কৃষকে পরিণত হয়। পদ্মার ভাঙনের ফলে হারিয়ে গিয়েছিল তাদের পাড়াপ্রতিবেশী, আত্মীয়স্বজন-সহ সকল আপনজন। নদীর নতুন গতিপথ সৃষ্টির প্রভাবে একটি বিশাল অঞ্চলের জনগোষ্ঠীর ভৌগলিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং মনস্তাত্বিক পরিবর্তনের ইতিহাস বর্ণিত হয়েছে উপন্যাসটিতে। তাই ‘ভাঙন’কে ঐতিহাসিক এবং আঞ্চলিক উপন্যাসের মিশ্রণ বলতে পারি। উপন্যাসের নায়ক শিক্ষিত ছেলে নয়ন যখন সব হারিয়ে জেলেদের সাথে পদ্মায় মাছ ধরার কাজে যোগ দেয় তখন তার সহকর্মি এবং মাছ ক্রেতা তাকে মাঝি সম্বোধন করলে প্রথম প্রথম তার খারাপ লাগলেও পরে সয়ে যায়।


শরীয়তপুরের আরেক সাহিত্যিক মানিক লাল সাধুর ‘পশ্চিম পাড়’ উপন্যাসটি ২০১৭ সালে প্রকাশিত হয়। শরীয়তপুরের অন্যতম নদী কীর্তিনাশার একটি শাখা চন্দ্রপুর বাজারের সামনে দিয়ে, সমিতির হাটের পাশ দিয়ে টেকের হাটের কাছে এসে শরীয়তপুর-মাদারীপুর জেলাকে আলাদা করে আবার কীর্তিনাশার প্রধান ধারার সাথে মিশেছে। উপন্যাসটিকে সমিতির হাটের পাশের একটি গ্রাম পশ্চিম পাড়ের নামে নামকরণ করা হয়েছে। ‘পশ্চিম পাড়’ উপন্যাসটিতে কীর্তিনাশার পশ্চিম পাড়ের মানুষের জীবন যাত্রা তথা আনন্দ-বেদনা, হাসি-কান্না ও প্রেম-ভালোবাসার গল্প উঠে এসেছে। শরীয়তপুরের আরেক কথা সাহিত্যিক খুরশীদ আলম এর ‘ভাঙনের পদাবলীতে’ পদ্মার ভাঙনের মুখোমুখি একটি পরিবারের সংগ্রামের নানা ঘাত প্রতিঘাতের গল্প উঠে এসেছে। শরীয়তপুরের অন্যতম গল্পকার সুলতান মাহমুদের অতিপ্রাকৃত গল্প ‘ফেরা’য় প্রমত্তা পদ্মায় লঞ্চ ডুবির ঘটনায় মৃত জুঁই নামের একটি মেয়ের সাথে মারা যাওার দুই বছর পর গল্পের নায়ক নাফিসের সাথে মাঝ নদীতে সাক্ষাৎ এবং জুঁই এর স্বপ্ন নিয়ে ট্রলারে কথপোকথন উঠে এসেছে গল্পে। গল্প উপন্যাসের পাশাপাশি শরীয়তপুরের কবি সাহিত্যিকদের ছড়া ও কবিতায় নদী এসেছে বারবার। এক্ষেত্রে পদ্মার ভয়াল রূপ এবং কীর্তিনাশা নদীর সৌন্দর্য বর্ণনার প্রাধান্য সব থেকে বেশি।


ভরা বর্ষায় পদ্মার রুদ্ররূপ বিভিন্ন কবির কবিতায় কীভাবে উঠে এসেছে দেখে নিই—‘পদ্মার মাঝি যারা জালু ও কানাই,/তাদের ভাষায় এটা দুরন্ত বানাই/থেকে থেকে ডাকে গরু হাম্বা স্বর/বৃষ্টির সুচাঘাতে গায়ে উঠে জুর’ (কবিতা: কার্তিকের কাক- মির্জা হজরত সাইজী)। ‘বৈরি বাতাস ঢেউ তুলেছে পদ্মা ফুলে ফেঁপে/ঢেউয়ের পরে ঢেউ দেখে তাই বুকটা ওঠে কেঁপে’ (কবিতা: পদ্মা সেতুর ছড়া-০১- ইব্রাহিম খলিল)। ‘পদ্মার ঢেউ আছড়ে পড়ে যখন আমার বুকে/রঙিন স্বপ্ন সব থেকে যায় কাঁদছি যুকে ঝুঁকে’ (কবিতা: ডুবো চর- অতুল চন্দ্র ওঝা)। ‘বর্ষাকালে দেখেছি ভয়ার্ত পদ্মার রূপ/ঢেউয়ের আঘাতে ভয়ে কাঁপতো বুক’ (কবিতা: আমিপদ্মা পাড়ের কন্যা- শাহ্ নাজ পারভীন)। ভয়ার্ত পদ্মা ভরা বর্ষায় বানাই উঠলে আরো বেশি রুদ্রমূর্তি ধারণ করে সবকিছু ভেঙেচুড়ে তছনছ করে দেয়—‘বসত বাড়ি যার পদ্মার পাড়ে সদা ভয়-ডর তার কাঁপে অন্তর/আঁৎকে উঠে বুক বজ্রের ন্যায় কখন যে ভেঙে যায় বাড়িঘর’ (কবিতা: পদ্মার গর্ভে- ওবায়দুর রহমান বাদল)। ‘আইতে আইতে পদ্মা নদী ভাইঙা নিল বাড়িঘর/মাতা গোঁজার ঠাঁইও গেল নদীর পেটে একের পর...’ (কবিতা: রাক্ষসী পদ্মা-ইয়াসিন আযীয)। ‘বাঁধন ছেড়া পদ্মা নদী রাগ করেছে আজ/সকাল সাঁঝে ভাঙছে শুধু এইতো তার কাজ/শহর নগর ভাঙছে বাড়ি ভাঙছে ধানের মাঠ/ভাঙছে গ্রাম স্থাপনা শান বাঁধানো ঘাট’ (কবিতা: পদ্মার প্রতি- শহীদুল ইসলাম পাইলট)। কখনো আবার, রাক্ষুসী পদ্মা করাল গ্রাসে সমস্ত কিছু তার বুকে নিয়ে নেয় তখন প্রবাসী কবির কণ্ঠে হতাশা, জন্মভূমিতে না ফেরার অভিমান ঝরে পড়ে—‘পদ্মা নদী ভেঙে নিলো রইল না আর কিছু,/কিসের আশায় ছুটব তবে জন্মভূমির পিছু!’ (কবিতা: রাক্ষুসী পদ্মা-সালেহ আহমেদ শিশির)


দুই একটি ব্যাতিক্রম ছাড়া কীর্তিনাশার ক্ষেত্রে নদীর নৈসর্গিক সৌন্দর্যের বর্ণনা এবং শৈশব স্মৃতিকাতরতা কবিদের লেখনির মাঝে বেশি পরীলক্ষিত। ‘নদীর তীরস্থ পথে বৃষ্টি গুনি হামাগুড়ি দিয়ে/চোখের পুকুরে চুপ চুপিসারে টাপুর টুপুর.../সকালের আহ্বানে মন্ত্রমুগ্ধ কীর্তিনাশা বাঁকে/দুপুর বিকেল ওড়না গায়ে দেখে রোদের সার্কাস...’ (কবিতা: স্মৃতির চড়ুই- রাজু আলীম)। ‘ঝিনুক খোলার ছুরি দিয়ে কিশোরী আম খেয়ে/ফিরেছি বাড়ি কীর্তিনাশায় সাঁতার কেটে নেয়ে’ (কবিতা: স্মৃতি ও প্রত্যাশা-মফিজুল ইসলাম)। ‘আমার গাঁয়ের ছোট্ট নদী কীর্তিনাশা নাম/কিশোর বেলায় শখের ভেলায় ভেসে বেড়াতাম’ (কবিতা: কীর্তিনাশার অতীত- নুরুল হক ঢালী)। ‘সবুজ শ্যামল ছায়ায় ঢাকা ফসল ভরা মাঠে/কীর্তিনাশা পার হয়ে যাই আঙ্গারিয়া হাটে’ (কবিতা: আমার ঠিকানা- হোসাইন মুহ: দেলোয়ার)। ‘মাঝে নদী কীর্তিনাশা দুই তীরে গ্রাম/বৈশাখ মাসে তার গাছে পাকে আম’ (কবিতা: অনুপম বাংলা- মির্জা গিয়াস উদ্দিন)। ‘কীর্তিনাশার হাট আঁকে/সাকু মাঝির ঘাট আঁকে/ফসল ভরা মাঠ আঁকে/আঁকে তৃণ খড়’ (কবিতা: বাংলাদেশের বুক- দেওয়ান আজিজ)। ‘ভোজেশ্বরের শিবের মেলা কীর্তনের আসর/কীর্তিনাশা নদী আছে পদ্মার বুকে চর’ (গীতি কবিতা- আখতারুজ্জামান জীবুল)


কীর্তিনাশা নদীর কথা সবথেকে বেশি উঠে এসছে কবি মোঃ ফজলুল হক এর কবিতায়। তাঁর একটি কবিতাতেই আটবার এসেছে কীর্তিনাশার নাম! তাঁর ‘বহতা নদীর কথা’ কবিতাটি পুরোটাই বাল্যকালের স্মৃতি বিজড়িত কীর্তিনাশাকে নিয়ে লেখা: ‘এই তো আমার কীর্তিনাশা, বাল্যকালের স্মৃতির জলধারা।/অফুরান স্মৃতির জোনাকি এখানে/এখনো পাখনা ছড়ায় অক্রেশ অরুণিমায়/দুরন্ত কৈশোর এখনও এখানে মুখর হয়/অবিনাশী সুরের ঝংকারে.../অতঃপর কীর্তিনাশার দুইকূলে সন্ধ্যা নামে/অতি সন্তর্পণে.../আহা কৈশোর।/আহা কীর্তিনাশা।/তোমার কাছে জমা আছে, দিনমান ডুবসাঁতারের খেলা, অবিরত নতুন স্বপ্ন।’


অনেকের কবিতায় শুষ্ক মৌসুমে পানি শুকিয়ে নদীর জীর্ণ দশা এবং বৈশাখ থেকে আষাঢ় পর্যন্ত আবার পানি বৃদ্ধি পেয়ে নদীর যৌবন ফিরে পাওয়ার দৃশ্য বর্ণিত হয়েছে। ‘আমার শৈশবের ডুব সাঁতারের নদী/মৃত সাপের মতো দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে/শরতের কাশফুলগুলো ফোটে না এখন আর/ছোট ডিঙিনৌকাটাও ভেঙে-চুরে একাকার/আহ শৈশব আশ্রিত কিংবা বিস্মৃত স্মৃতি।’ (কবি: সফিক রহমান)। ‘এসেছে নতুন বছর/এসেছে বৈশাখ মাস/এসেছে কীর্তিনাশায় জোয়ার/নাচে মাছরাঙ্গা, পানকৌড়ি আর হাঁস।/মাটি ফেটে হয়েছে চৌচির/উড়ে যায় তৃষ্ণার্ত কাক/কেহে যাবা হেই পাড়েআ-হো.../হাঁটু পানিতে নেমে মাঝি দেয় হাঁক।’ (কবিতা: বৈশাখ- ইয়াসিন আযীয)। ‘বৈশাখে হাঁটুজল, জৈষ্ঠ্যে বাড়ে ধীরে/আষাঢ়ে কীর্তিনাশা, যৌবন পায় ফিরে’ (কবিতা: কীর্তিনাশার রূপ- ফিরোজ ভূঁইয়া)


কবি নাজমুল হক এদের সকলের থেকে ব্যতিক্রম। শৈশবের নদীর প্রতি তাঁর অকৃত্রিম ভালোবাসা এতটা গভীর যে মৃত্যুর পর সমাধি যেন নদীর পাড়ে হয় এই নছিহত তাঁর ‘যদি আমি চলে যাই নিশ্চিত গন্তব্যে লোভনীয় বর্ষায়/কথা দাও আমার সমাধি দিও কীর্তিনাশার পাড়ে’ (কবিতা: আমার সমাধি দিও কীর্তিনাশার পাড়ে- নাজমুল হক)


অপরদিকে পদ্মা ও কীর্তিনাশা মানুষের বসত ভিটা, রাজবল্লভের একুশ রত্নই শুধু গ্রাস করেনিরথখোলা খাল, কালিগঙ্গা ও পালং নদী এবং নড়িয়া খালকে তাদের গর্ভে বিলীন করে নিয়েছে। এসব কথাও উঠে এসেছে কবিতায়—‘কতো নদী বিনাশ করে হইছে কীর্তিনাশা/বয়ে চলা তীব্র স্রোতে কেড়ে নিছে আশা’ (কবিতা: কীর্তিনাশা- উদ্দিন জালাল)। কবি মো. মজিবুর রহমান দেওয়ানের কবিতায় কীর্তিনাশাকে পদ্মার শাখা নদী হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে। ‘কীর্তিনাশা নদী তুমি পদ্মা নদীর শাখা/হেলেদুলে চলছ তুমি যেন আঁকাবাঁকা’ (কবিতা: কীর্তিনাশা নদী- মো. মজিবুর রহমান দেওয়ান)। আমরাও কীর্তিনাশাকে পদ্মার শাখা নদী হিসেবেই জানি। কিন্তু পদ্মার শাখা নদী হওয়ার শর্ত পূরণ করা সত্ত্বেও উইকিপিডিয়ায় কীর্তিনাশাকে পদ্মার শাখা নদীর তালিকায় পাওয়া যায় না।


গল্প, উপন্যাস এবং ছড়া-কবিতার পাশাপাশি নাটকেও উঠে এসেছে কীর্তিনাশা। কবি রাজু আলীমের রচনায় ‘কীর্তিনাশা পরী’ নামের একটি নাটক বাংলাদেশ টেলিভিশনে সাপ্তাহিক নাটক হিসেবে প্রচারিত হয় ২০১২ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি। এই নাটকে উঠে এসেছে কীর্তিনাশা নদীর ইতিহাস, নদীর পাড়ের মানুষের জীবন-যুদ্ধের গল্প, স্মৃতি বিজড়িত স্থানগুলোর বর্ণনা প্রভৃতি।


পদ্মা ও কীর্তিনাশার কথা যেভাবে বা যতবার এসেছে শরীয়তপুরের কবিদের কবিতায়; ততটা আসেনি শরীয়তপুরের অন্যান্য নদীর কথা। আড়িয়াল খাঁ একাধিক জেলার মধ্য দিয়ে অতিক্রম করার সময় তার ভাঙনপ্রবণ অবয়ব নিয়ে শরীয়তপুরেও উঁকি দিয়েছে। ‘আমাগো বাড়ি প্রিয়কাঠি আড়িয়াল খাঁ’র পাশে/হেই হানেতে অভিজিৎ দাস খুল্ল খুল্লু কাশে’ (কবিতা: নেমন্তন- ঋজু রেজওয়ান)। ‘আমি মাদকে মদ্যপ হই না কিংবা আফিমের ধূম্রতায়, মদ্যপ ওগো করে যে আমায়/জয়ন্তী নদীর তীরে বসে খাওয়া এককাপ চা’য়’ (কবিতা: রূপসী জয়ন্তী-আব্দুল্লাহ আল মাসুদ)। ‘জয়ন্তী নদীর তীরে গল্প বলে স্রোত,/পাড়ের কোলে বসে শুনি প্রকৃতির নোট’ (কবিতা: জয়ন্তী নদীর তীরে- মোঃ বিল্লাল হোসেন ইমন)। দামুদিয়া বা দামোদিনী এবং ভয়রা নদীর সাথে তাঁর মিশে থাকা স্মৃতির চমৎকার বর্ণনা পাওয়া যায় কবি শাহ জালাল মিয়ার কবিতায়। ‘দামোদিনী নদীর প্রবল শ্রোতে ভাসতে ভাসতে গাঙ্গুর, কালিগঙ্গা হয়ে শেষে/জোৎস্নারানিদের স্নানঘাটের মুখর মোহনায় থমকে গিয়ে দেখি নেই/আমার শৈশবের জলখেলার সেই সঙ্গীরা কেউ নেই।’ (কবিতা: আজও বৃষ্টিহীন মেঘের মতো স্বপ্নহীন আমি- শাহ জালাল মিয়া)। ‘ভয়রা নদীর স্বচ্ছ জলে ডুবসাঁতার কাটছিল যে কিশোরী/তার স্বপ্নীল চাউনির অর্থ খুঁজিনি সেদিন’ (কবিতা: ভয়রা নদীর পাড়ে- শাহ জালাল মিয়া)


শরীয়তপুরের প্রায় সকল কবি-সাহিত্যিকদের লেখায় কোনো না কোনো ভাবে নদী এসেছে বিভিন্ন রূপে। ‘পদ্মা-মেঘনা-যমুনাটাই দেশের বড় নদী/সাতমোহনা, আড়িয়াল খাঁ, বইছে নিরবধি’ (কবিতা: কত নদী শত নদী- নজরুল ইসলাম শান্তু)। শুধু যে শরীয়তপুরের নদীর কথাই এসেছে তা নয়। দেশের প্রধান প্রধান নদীর কথা এসেছে তাঁদের লেখা কবিতার বিভিন্ন উপমায়। ২০২৩ সালে প্রকাশিত কীর্তিনাশার কাব্যে বর্ষা সংখ্যায় কবি নজরুল ইসলাম শান্তুর ‘কত নদী শত নদী’ কবিতাটিতে দেশের পয়তাল্লিশটি নদীর নাম উঠে এসেছে! কবি আমিনুল শাহ এর কবিতায় মহানন্দাকে (আমি খেয়ামাঝি, তুমি মহানন্দা) তাঁর প্রেমিকার সাথে তুলনা করতে দেখতে পাই। এছাড়াও কবি ও ভ্রমণকাহিনিকার কামরুল হাসানের ভ্রমণকাহিনিতে ‘জয়ন্তী ও দামুদিয়ার’ বর্ণনা পাই। মোশারফ আলী, গেরিলা আজাদ, সুপাছ মিজান, সব্যসাচী নজরুলসহ আরও অনেকের কবিতায় পদ্মা সেতুর সৌন্দর্য এবং পদ্মা ভাঙন পরবর্তি বেড়িবাঁধের বর্ণনা পাওয়া যায়। এ জেলার কবিগণ গাঁয়ের মায়ায় যেমন স্মৃতি বিজড়িত নদীনালার কাছে ফিরে আসতে চায়; ঠিক তেমনি প্রিয় বন্ধু, আত্মীয়দের পদ্মা পাড়ি দিয়ে শরীয়তপুর বেড়াতে আসতে নিমন্ত্রণ দিতেও ভোলেন না ‘চলো না মা যাই গেরামে থাকব সবুজ ছায়ায়/মেঠো পথ আর নদীনালা পুকুর ঘাটের মায়ায়’ (কবিতা: গাঁয়ের মায়া- সুপান্থ মিজান)। ‘পদ্মা মেঘনা কীর্তিনাশা লগে জয়ন্তী/বিনোদপুর পালং গাঙ আছে নড়িয়া খাল/জাউল্লারা বেক মাছ ধরতে উত্তাল ঢেউয়ে/নাও ভাসায় উরাইয়া দিয়া পাল’ (কবিতা: চলো শরীয়তপুর- কে. এম. ওসমান গনী)। ‘আমার গাঁয়ে যাইও বন্ধু পাখির মেলা বয়/পদ্মা নদী পাড়ি দিলেই চির সবুজ বৃক্ষময়’ (কবিতা: নিমন্ত্রণ- মু মু হাসান)


তবে পদ্মায় রুপালি ইলিশ মাছ ধরার বর্ণনা এ জেলার কবিদের কবিতায় খুব একটা পাওয়া যায় না। এছাড়াও জেলার নদীগুলোর ১৯৭১ সালে আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে অনেক ভূমিকা ছিল। যুদ্ধের অনেক ইতিহাস জড়িয়ে আছে এসব নদীর সাথে। সেসবের কোনো বর্ণনা আমার চোখে পড়েনি এ জেলার কবি-সাহিত্যিকদের লেখায়। তবে কীর্তিনাশার শৈশব স্মৃতি নিয়ে আমার লেখা একটি স্মৃতিগদ্যের দুটি স্থানে উল্লেখ রয়েছে মুক্তিযুদ্ধকালীন নদীবিষয়ক বর্ণনা। মুক্তিযুদ্ধের সময় নদীর ভূমিকা এই জেলার কবি-সাহিত্যিকদের লেখায় উঠে আসলে শরীয়তপুরের নদীকেন্দ্রীক সাহিত্য আরো বেশি সমৃদ্ধ হতো।

তথ্যসূত্র:

০১। শ্রেষ্ঠ গল্প- আবু ইসহাক।

০২। বাংলা ভাষা ও সাহিত্য জিজ্ঞাসা- ড. সৌমিত্র শেখর।

০৩। কবি ও কবিতা শরীয়তপুর- শ্যামসুন্দর দেবনাথ সম্পাদিত।

০৪। কাব্য মিতালি শরীয়তপুরের শত কবির কবিতা- সুপাস্থ মিজান সম্পাদিত।

০৫। কীর্তিনাশার কাব্য (বিভিন্ন সংখ্যা)।

০৬। শরীয়তপুরের সাময়িকী ‘'পথ’- সম্পাদক: মনির আহমদ।

০৭। ভাঙন (উপন্যাস)- রেদোয়ান মাসুদ।

Post a Comment (0)
Previous Post Next Post