একগুচ্ছ কবিতা :: স্বপন মাঝি
এক নিঃসঙ্গ লেলিন
জ্বলে উঠেছিল একদিন,
অরণ্যের ভেতর কোন এক বজ্র-বর্ণা...
বৃষ্টির শব্দে হারিয়ে গেছে শোষকের পদচিহ্ন,
কোনো কুয়াশার ঘূর্ণিতে কাঁপে
লুণ্ঠনের নিঃশব্দ গর্দান।
আমি দেখেছি—
চরের ঘাসের ফাঁকে ফাঁকে
রক্তের আলপনা এঁকে গেছে এক দস্যু,
সে কি ছিল মানুষ?
নাকি ইতিহাসের অভিশপ্ত চিৎকার?
আমার অন্তরে
এক নিঃসঙ্গ লেলিন,
বাইরে... ধোঁয়া—
আঙুল ছুঁয়ে দেখেছি আগুন নয়,
ধ্বংসের ভেতরে এক আশ্চর্য নরমতা।
তখন
ছিঁড়ে ফেলি কালো পাণ্ডুলিপি—
পড়ে দেখি:
“আমি মানুষের কবি—
নিপীড়িতের পণ,
আলো নয়—আমি এক শীতল আগুন।”
আমি বারবার হারাই—
আবার ফিরে আসি...
চির-বিদ্রোহ নই,
আমি এক দীর্ঘ প্রতীক্ষা।
প্রেম, বারুদের মতো
সে এল—
না, এল না—
ধেয়ে এল!
পদশব্দহীন,
তবু আমার মেরুদণ্ড ফাটিয়ে!
দরজা খুলিনি আমি,
সে নিজেই হিঁচড়ে খুলে ফেলেছে—
বুকে ঢুকেছে!
আর আমি?
আমি তখনো মানুষ!
আলো ছিল,
তবু আর কিছুই দেখা যেত না—
চোখ ভরে গন্ধ,
না, গন্ধ নয়—
বারুদের মতো প্রেম!
সে বলল না,
সে হাঁসল না,
সে থামল না—
সে শুধু দগ্ধ করল!
পোড়ে বিছানা,
পোড়ে আয়না,
পোড়ে নামহীন কাগজগুলো—
যেখানে লিখেছিলাম:
ভালোবাসি...
তিনবার, একই নামে।
তবু, ওই যে মানুষ—
আমি, দাঁড়িয়ে আছি এখনো,
হাড়ে আগুন,
চোখে পাথর,
আর ঠোঁটে এক অসমাপ্ত উচ্চারণঃ
থামো!
কিন্তু প্রেম থামে না—
সে আসে বারবার,
অগ্নিকাণ্ডের ধোঁয়া নিয়ে,
চোখে বিস্ফোরক রেখে!
ভেতরে যতটুকু মানুষ ছিল,
সব পুড়ে গেছে—
শুধু একটা ছাইয়ের স্তূপে
আজো আমি দাঁড়াই—
দরজা খুলে,
বুক উলঙ্গ,
জিভে আগুনের স্বাদ নিয়ে
চিৎকার করি:
আবারও এসো!
আবারও পোড়াও!
আবারও আমাকে ভালোবাসো!
আমার চৈতন্যে আগুন লাগুক
ডামাডোল বাজে? বাজুক!
আমি সময়কে চাবুকে বেঁধে টানি—
এই রাত, এই জোছনা,
সব নির্লজ্জ চুপচাপ দৃশ্য—
আমি উল্টো করে দিই,
চাঁদের মুখে থুতু ছুড়ে বলি—
আলো নয়, আগুন চাই!
রেলগাড়ি দাঁড়িয়ে?
দাঁড়িয়ে থাক—
আমার ধমকে লোহার চাকা কাঁপে!
কে ফিরছে স্বপ্ন থেকে?
স্বপ্ন মরে গেছে কবেই!
আমি চৈতন্যে আগুন ধরাতে এসেছি—
ভাঙো! জ্বালাও! লিখে দাও নতুন আকাশ!
নক্ষত্র?
ওরা তো সময়ের পুরনো অভিনেতা!
আমি নক্ষত্র ছিঁড়ে আনি,
নতুন বিপ্লব আঁকতে আকাশে।
দুই ঋতুর মিলনবিন্দু
তুমি এলে—
বর্ষার নদী এসে জড়িয়ে ধরলো বসন্তের গাছ—
তোমার চোখে ছিল ভোরের কুয়াশা,
তোমার কণ্ঠে রোদ পাকা দুপুরের গরম।
তোমার সাথে হাঁটতে হাঁটতে—
পৃথিবী বদলে যায় রঙে আর গন্ধে,
মাঠে হঠাৎ ফুল ফুটে ওঠে,
বাতাসে লেগে থাকে কাঁচা আমের স্বাদ।
আমি জানি—
ভালোবাসা আর বন্ধুত্ব
দুই ঋতুর মতো একসাথে আসে খুব কম—
তুমি সেই বিরল ঋতু—
যাকে হারালে বছরের সব ক্যালেন্ডার ফাঁকা হয়ে যাবে।
মাটির শপথ
দিল্লির ছায়া নয়—
পিন্ডির বিষদাঁত নয়—
অগ্নিশিখা জ্বলে ধূলির অন্তরায়!
রক্তের অক্ষরে লেখা এই মাটির গান,
ঝড়ের আঁধারে দাঁড়ায় স্বপ্ন অবিরাম!
শত শত্রু এলে—
বাজে ঢেউয়ের ঢাক!
অক্ষয় প্রতিজ্ঞা—
এই ভূমিই আমাদের শক্তি !
নাড়ির টানে জেগে ওঠে ধানের মাঠ,
বিজয়ের রোদে জ্বলে সংগ্রামের রথ!
ভয় নয় মৃত্যু—
পথের সাথী সে শুধু!
এই ভূমিই শপথ,
এই ভূমিই সম্বল!
দিল্লি বা পিন্ডি—
কোথাও নেই মান,
বাংলার শিরায় বাজে প্রাণের গান!
চলো, দেশপ্রেমের পতাকা উঁচু করো,
জাগো, উঠো—
ধ্বনিত হোক বিজয়ের সুর!
ভেতরের বিষ
বড় রক্ত বাজে—শিরায়!
বিদ্যুৎ খেলছে—অদৃশ্য, ঝলমল!
সকালও অন্ধকার—ঘর ঢেকে দেয় সব আলো।
মূর্খ ঘুরে যায়—হাওয়া!
চারপাশে—ছায়া—ছায়া!
অদৃশ্য শরীর খেলে—কাঁপে—চেঁচায় না!
পথে—লোক নেই!
দুই—চারটে জীব হেঁটে চলে।
বাঁকে বাঁকে—অনিশেষ ভয় ঝরে!
অন্তর কাঁপে—মনে পড়ে—ভেতরে ঢুকে গেছে বিষ।
নীরব—নীল—স্রোতে!
কেটে যায় না—আমরণ!
ক্ষত! রক্ত! হিংসে! গ্লানি!
হাহাকার—ঢেউয়ে এসে ঘরে!
সব কত সাবলীল—অনিশ্চিত!
আগামীর দিকে—টেনে নেয় আমাদের পায়ের শেকল।
কঠোর! অনমনীয়!
লোহার মতো!
ভেতরে বিষ ঢুকে—ধ্বনিতে কেঁপে ওঠে হৃদয়!
হুঙ্কার!
আমার জমি—
শিকল বাঁধা!
হায়েনার দাঁতে ছিঁড়ে খাওয়া
আমার ধান, আমার স্বপ্ন!
আমি দৌড়াই—
মরুভূমি জুড়ে,
সঙ্গী কেবল—
অমাবস্যার কালো খুলি!
হৃদয়ে প্রেম?
না—
নিষ্ঠুর কসাইখানা!
যেখানে ঝর্ণা নয়,
রক্ত ঝরে বজ্রের মতো!
জননী!
আমি তোমায় প্রশ্ন করি না—
কারণ উত্তর নেই!
দুঃখ ঠুকে ঠুকে
ভাঙে মাথা—
এই প্রহসনের ইটে!
শোনো!
আমার ভালো লাগে না কিছুই—
না গান,
না ভোর,
না আকাশ!
কিন্তু—
শ্লোগানের আগুনে
যখন উঠবে মিছিল,
তখন দেখব—
শিক্ষাগুরু লাঞ্ছিত হলেও
তাঁর চোখে বিদ্রোহের স্ফুলিঙ্গ!
আমি দাঁড়াবো—
ডোম ঘরের চৌকাঠে,
আর আকাশে ছুঁড়ে দেবো—
লোহার অক্ষরে লেখা—
স্বপ্ন!
আমি বিপ্লব তুমি ক্রেতা
কেউ ঠ-কায় না!
মানুষই বি-কোয়—
মুখে হাসি,
ভেতরে ধোঁকা।
চোখে রঙ,
জিভে মিঠে দাগ,
আর ব্যাংক একাউন্টে—
রাশি রাশি প্রেম!
কে বিক্রি হল আজ?
তুমি?
আমি??
না কি সেই বার্নিশ করা ঈশ্বর!
হাট বসেছে—
হৃদয়ের
ঠিক মাঝখানে!
স্মৃতি!
রক্ত!
চুম্বন!
সবই ট্যাগযুক্ত মাল!
আমি
বিপ্লবকে
ভালোবেসে পুড়েছি—
তুমি কিনেছ আমার ছাই!
হে অচেনা
হে অচেনা, ডাকো—
দূরের বাতাসে ভেসে,
শূন্যে ভেসে, আড়ালে অস্তিত্বের ছায়া।
আমি ভাঙা টুকরো, তুমি স্বপ্নের খণ্ড;
মেলিনি আমরা, তবু অমর, অবিনাশী।
দিন আসে বলে—
কুঁড়ি নেই, আলো নেই;
নিঃশ্বাস ডুবে গেছে শূন্যের নিঃসঙ্গতায়।
আয়নার কাচে, ভাঙা ভাঙা রক্তের রেখা;
বাজে আমাদের গান, কণ্ঠস্বরের ছায়া।
হে অচেনা—ডাকো,
শূন্য ভেদ করে;
মনে ঘুরে যায় অদৃশ্য পথে আমাদের।
পুনরাবৃত্তি—
আমি ভাঙা, তুমি খণ্ড;
অসম্পূর্ণ আমরা, তবু অমর থাকি।
ডাকো, হে অচেনা,
শূন্যে ভেসে, আলো খুঁজে;
আমাদের অন্তরের মাঝে ফিরে আসো।
হৃদয়ের ঋতুচক্র
সূর্যের মতো ফেটে ওঠে হৃদয়,
ঝড়ে গলে যায় রুপালি ব্যথা।
পাতা ঝরে পড়ে—
সময় হেসে যায়,
তবু মরুভূমি চায় পুনর্জন্ম!
কাঁটার প্রাচীরে লতা ছিঁড়ে ফেলে বাঁধন,
পাথরের দেয়ালে ফুল ফোটে—
আবছা, অমোঘ, অবিনাশী।
হৃদয় মানেই ব্যথা!
ব্যথা মানেই হৃদয়!
নেভে—জ্বলে—জ্বলে—নেভে—
তবু কাব্য লিখে যায় অনন্ত ঋতু।
------------
কবি স্বপন মাঝি, জাজিরা, শরীয়তপুর।
সব গুলো কবিতাই অসাধারণ হয়েছে।কবি স্বপন মাঝির লেখা কবিতার আমি একজন নিয়মিত পাঠক।তার লেখা আমার কাছে অত্যন্ত ভালো লাগে।
ReplyDeleteধন্যবাদ
Delete