থার্ড ক্লাস প্যাসেঞ্জার :: রথীন্দ্রকান্ত ঘটক চৌধুরী
শশাংক দারুন অস্বস্তিতে ঘন ঘন চুরোট
ধরিয়ে নিচ্ছিল। ঈষৎ কুণ্ডিত কপালের রেখায় ঘর্ম দেখা দিয়েছে, চক্ষু দুইটি উগ্র
রক্তমাভ, দৃষ্টিতে সহযাত্রীদের প্রতি রুঢ় উদাসীনতা চোখের কাছ থেকে ঠেলে সমস্ত
থার্ড ক্লাস কম্পার্টমেন্টটাকে উহ্য করে দিতে চায়। তার সুসভ্য বেশভূষায় খুঁত নেই
কোথাও। স্যুটের নীচের অভিজাত মনটা আশে-পাশে ঠোকর খেয়ে ঘামিয়ে উঠছিল। জীবনে এতবড়
অস্বস্তিতে তাকে পড়তে হয়নি কখনো। নিতান্ত গ্রহের ফেরই বলতে হবে। কোথাকার
সৈন্যবিভাগের বড় কর্তারা সদলবলে ফার্স্টক্লাস আর সেকেন্ড ক্লাসের সমস্ত কামরাগুলো
দখল করে নিয়েছে; শশাংক নিরুপায় হয়ে ইন্টারেও খোঁজ নিয়েছিল, সেখানকার জনসমুদ্র দেখে
রীতিমত শংকিত চিত্তে তৃতীয় শ্রেণীর শরণাপন্ন হয়েছে।
শশাংকের পালিশ করা রুচির কাছে সামনের
সমস্ত মানুষগুলো বিস্বাদ হয়ে উঠেছে। তাদের পোষাক পরিচ্ছদের অপরিচ্ছন্নতায়,
ব্যবহারের অমার্জিতরূপে, কথাবার্তার কুৎসিত ভংগীতে শশাংককে নিদারুণ বিচলিত করে
তুলেছিল। ইতস্ততঃ বিক্ষিপ্ত বাক্স-তোরংগ, ছোঁড়া নেড়কা, কাগজপত্রের ছড়াছড়ি অসহ্য
ঠেকছিল শশাংকের কাছে। বাইরে পশ্চিম দিকের আকাশটায় সূর্য অস্ত যাচ্ছে, মেঘে মেঘে
লাল আবির ছড়ানো রুক্ষমাঠের কোথাওবা যুথভ্রষ্ট তালগাছ একচ্ছত্র অধিকারে মাথা তুলে
দাঁড়িয়ে আছে। বাইরের দিকে দৃষ্টি প্রসারিত করে শশাংক তবু যেন হাপাবার অবসর পাচ্ছে।
সো সো শব্দে হাওয়া এসে শশাংকর চোখেমুখে ঝাপিয়ে পড়ছে একেকবার—শশাংক
যা হোক একটু আরাম খাঁজে পেলো।
‘‘দেখুন, দয়া করে পা দুটো একটু নামিয়ে
বসবেন—ওদিকে
আর জায়গা নেই।” শশাংক বাইরের দিক থেকে চোখ ফিরিয়ে আনলো।
চেয়ে দেখলো লম্বা কালো ছিপছিপে চেহারার
একটা লোক হাতে কী-একটা পুটলি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। গায়ের জামাটা থেকে দুর্গন্ধ এসে
ঝলক দিয়ে শশাংকর নাকে প্রবেশ করলো। লোকটির চেহারা, কথাবার্তার ধরন শশাংককে অস্থির
করে তুলছিল। মুখে ব্রনের অস্বাভাবিক ক্ষতচিহ্ন, ঘামে ভিজে আরও কদর্য হয়ে উঠেছে,
সামনের দিকের চুলগুলি নাসিকার অগ্রভাগ পর্যন্ত নেমে এসেছে, নাকটা মঙ্গোলিয়ান ছাপের
উগ্ররকমের থেবড়া, শশাংক পা নামিয়ে যতদূর সম্ভব সরে বসলো—মনটাকে
যথাসাধ্য উদাসীন করে তুলবার জন্য জানালা দিয়ে যতদূর যায় গলা বাড়িয়ে দিল।
“দেখুন মশাই, দয়া করে একটু এদিকে
তাকাবেন”—শশাংক
তাকিয়ে ফেলে মনে মনে ভাবে অন্যায় রকমের দুর্বলতা প্রকাশ হয়ে পড়লো হয়তো। দুই চোখের
কড়া দৃষ্টি বিস্তার করে শশাংক লোকটার দিকে চাইল।
হাতের পুটলিটা সরিয়ে রাখতে রাখতে লোকটা
বলতে লাগলো, “জায়গা নেই তাই আপনাকে একটু জ্বালাতন করতে হলো। মাফ করবেন। থার্ড
ক্লাসের যাত্রীরা চিরকাল এমনি জ্বালাতন ভোগ করে আসছে। এক ছটাক জায়গাকে কোনরকমে
ভাগাভাগি করে চলতে হয় আমাদের—সুযোগ সুবিধার কথা ছেড়েই দিলুম—প্রাণ বাঁচলেই যথেষ্ট
মনে হয়।” শশাংক হতবুদ্ধি হয়ে উত্তর খুঁজে পেলনা। অসংলগ্ন কথাগুলির ফাঁকে এক আধটু
সৌজন্য প্রকাশের চেষ্টা কোথাও হয়তো ছিল, কিন্তু প্রকাশের ভঙ্গিটি শশাংকের মনের
ক্ষতস্থানে যেন নুন ছিটিয়ে দিল। নির্বাক শশাংক নির্বিকার ভাবে সমস্ত
কম্পার্টমেন্টটার দিকে একবার চোখ বুলিয়ে নিল।
আকাশে অন্ধকার নেমে এসেছে। তীব্রবেগে
ঠান্ডা হাওয়া দিচ্ছে। জানালাটা বন্ধ করে না দিয়ে উপায় ছিল না। নিবিয়ে রাখা চুরোটটা
জালিয়ে নিল শশাংক। লোকটা ঠিকঠাক হয়ে বসে শশাংকের দিকে অতিরিক্ত রকমের মনোযোগী হলো।
দৃষ্টিতে উগ্ররকমের ঔৎসুক্য, বিনয়ের বিন্দুমাত্র বালাইও তাতে নেই। শশাংক উদ্ধত
আভিজাত্যের প্রচুর শক্তি নিয়েও লোকটার উৎসুক দৃষ্টির সামনে রীতিমত ঘামিয়ে উঠলো—উসখুস
করে চুরোটটা নিবিয়ে দিল বিনাকারণে, জানালাটা ঠেলে খুলে দিয়ে প্রাণপণ শক্তিতে
চোখমুখ বুজে রইল।
“দেখুন, আপনার খুব কষ্ট হচ্ছে বুঝতে
পারছি। কিন্তু আমারও একটু জায়টা করে বসা ছাড়া উপায় ছিল না, বহুদূর থেকে হে'টে
এসে স্টেশনে ট্রেনে উঠেছি। ক্ষমা আপনাকে
করতেই হবে।” শশাংক চমকে উঠলো—ক্ষমা করুতেই হবে। কন্ঠস্বরেও লোকটার অস্বাভাবিক দাবির জোর।
শশাংক লোকটার আগাগোড়া ব্যবহার বিশ্লেষণ করে দেখলো, সংকোচের আব্রুতে কোথাও কথা বাধা
পায় না, সৌজন্য প্রকাশ করতেও হয়তো চেষ্টা করে, অথচ সবটা মিলে শশাংকের কানে তীরের
ফলার মতো প্রবেশ করে।
“আপনারা উচ্চ শিক্ষা পেয়েছেন, অনেক
দেশ-বিদেশ গিয়েছেন, বড়ো বড়ো লোকের সংগে মিশেছেন। আর আমরা দেখুন বর্ণ পরিচয়ের প্রথম
সোপানের বেশী এগুতে পারিনি—কোন রকম জমিজমা দেখে চাষবাস করে দিনাতিপাত করতে হয়। আমার দশ
বছর বয়সে বাবা মারা গেলেন, ওয়ারিশ সুত্রে পেলুম একজোড়া বলদ, আর একখানা খড়ের ঘর আর
কাঠা কয়েক জমি—তা দিয়ে নেড়েচেড়েই পয়ত্রিশটা বছর কেটে গেল। কোন সুযোগেই
বিদ্যা শিক্ষা করবার আর এতটুকু ফাঁক পেলুম না।” লোকটার আত্মজীবনীর এতো বিস্তৃত
বিবরণী কে শুনতে চায়? শশাংক মাঝখানে বাধা দেবে ভাবছিল, ‘দেখুন, ওসব জেনে আমার লাভ
নেই’ কিন্তু মুখের কথা গলা পর্যন্ত এসেই আটকে গেল। শশাংক লোকটার চরিত্র আগাগোড়া
বিচার করে বুঝলো অতিরিক্ত রকমের মিশুক। শশাংকের এমন রূঢ় উদাসীনতা এবং স্তব্ধতা তাকে
বিন্দুমাত্রও বিচলিত করতে পারেনি।
কী-একটা ছোট স্টেশনে গাড়ি ভিড়তেই লোকটা
দরজা পর্যন্ত এগিয়ে গেল। একদল ছেলেমেয়ে হুড়মুড় করে গাড়িতে উঠে বসলো। একটি বৃদ্ধ
উঠতে গিয়ে শোচনীয় ভাবে পড়ে যাচ্ছিল, লোকটা অযাচিতভাবে তাকে প্রাণপণ টেনে তুললো, “লাগে
নিতো কোথাও?” বৃদ্ধ সকৃতজ্ঞ দৃষ্টিতে লোকটার পানে চেয়ে রইল, “দীর্ঘজীবি হও বাবা।
আজকে বড় রকমের বাঁচিয়েছ। জীবনের কোনই আশা ছিল না।”
“আশা পুরো মাত্রায়ই ছিল, আমাদের
ছোটলোকদের মরণ নেই বুঝলে বুড়ো—যম বেটা নরকের আবর্জন। বাড়াতে চায় না।” লোকটার মন্তব্য শুনে
বৃদ্ধ ভীষণ ভাবে ক্ষুণ্ণ হয়েছে তার চোখমুখ দেখেই তা টের পাওয়া গেল, শশাংক কৌতূহল
দমন করতে না পেরে একদৃষ্টে চেয়ে দেখছিল। লোকটা বলেই চলেছে, “তা তুমি রাগ করো আর
যাই করো, সত্য কথা বলতে আমি কাউকে কসুর করিনে, ঠোঁটকাটা বলে দুর্নাম আছে, আর বাকি
জীবনে কোন কালে তা ঘুচুবার ও আশা নেই—” ইতিমধ্যে সে পকেট থেকে বার করে বহু
যত্নে রক্ষিত একটা বিড়ি ধরিয়ে নিয়েছে।
গাড়ি স্টার্ট দিয়েছে। লোকটা ফিরে এসে
শশাংকের পাশে বলো। ওদিকের বেঞ্চিতে একটি অল্প বয়স্কা বৌ শিশুর কান্নায় বিব্রত হয়ে
উঠেছে, সমস্ত কম্পার্টমেন্টের লোকগুলিও বিরক্তিতে দাঁতমুখ খি’চে কোন রকমে বসে আছে
যেন। দু’একজনের মুখ থেকে উষ্ণতা মিশ্রিত দু’একটুকরো মন্তব্যও বেরিয়ে আসছে। লম্বা
ঘোমটা টেনে বৌটি লজ্জায় অস্বস্তিতে ঘামছিল। তার সহযাত্রীটি একপাশে টান হয়ে নাসিকা
গর্জন করছে।
লোকটার অদ্ভুত ভাবান্তর হলো। মুখের
রেখায় রেখায় কিছুক্ষণের মধ্যেই তা পরিস্ফুট হয়ে উঠলো। সে আশ্চর্য রকমের লম্ফ দিয়ে
ওদিকের বেঞ্চিটার দিকে চলে গেল, ‘দেখি মা, ছেলেটাকে আমার কাছে দাও’, বলে একরকম জোর
করেই শিশুটাকে বুকের কাছে টেনে নিল। তারপর তার মুখ থেকে খৈ-এর মতো নানা রকমের
গ্রাম্যছড়া বেড়িয়ে আসতে লাগলো। শিশুটি ভয়ে হোক বিস্ময়ে হোক স্তব্ধ হয়ে বড় বড় চোখ
দু’টি মেলে লোকটার মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। গাড়িশুদ্ধ লোকগুলোর যেন ঘাম দিয়ে জ্বর
ছাড়লো। লোকটা অদ্ভুতভাবে বক্তৃতার ভংগীতে বলে যাচ্ছিল, সম্বোধনটা কোনও ব্যক্তি
বিশেষকে নয়—একেবারে নিছক সার্বজনীন কামরার সমস্ত লোক গুলোকে ছাড়িয়েও তার
বাণী সর্বমানবের কানে আশ্রয় পাক্ এ আকাংক্ষাও তার মনে সুপ্ত হয়ে ছিল কিনা কে জানে।
“দেখুন, আমরা হচ্ছি গরীব ছোটলোক—থার্ড ক্লাসের যাত্রী। অতো সুযোগ সুবিধে দেখলে কি আর আমাদের
চলে। একটি ছোট্ট শিশু কেদেছে কি আমরা যেন গরম তেলে চুবিয়ে ছটফট করছি, অথচ একেকজনের
বাড়িতে দিনরাত চব্বিশ ঘণ্টা হয়তো নানা রকমের ঐক্যতান চলছে।” শশাংক যতটা পারে
সংকুচিত হয়ে এককোণে চেপেচুপে বসলো। ইতিমধ্যেই সর্বশরীর তার ঘর্মাক্ত হয়ে উঠেছে,
মনটা চতুর্দিক থেকে অস্বস্তিকর খোঁচা খেয়ে খেয়ে একেবারে তিক্ত হয়ে উঠেছে। এমন
অদ্ভুত লোক শশাংক জীবনে দেখেনি। চোখ তুলে যার দিকে চাইতে ঘৃণায় সর্বশরীর কিলবিল
করে ওঠে, নিজে যেচেই সে সবটায় নির্বিকার ভাবে ঝাপিয়ে পড়ছে। এই খোলামেলা আটপৌরে
ব্যবহারে শশাংক নিজে নিজেই যেন লজ্জিত হয়ে উঠছিল। লোকটির বক্তৃতার বিরাম নেই, “আপনারা
অনেকে আমার কথা শুনে রাগ করবেন জানি, তাতে আমি কিছু মনেও করবো না, কিন্তু আমার
কথাটা একটু ভাল করে ভেবে দেখবেন। এই যে আমরা বাহাত্তর জনের স্থানে শ' খানেক
মহাত্মা গাদাগাদি করে বসে ঘেমে উঠছি, হাত পা নাড়াচাড়া করতে অক্ষম হয়ে নিজেদের
একেকজনকে জ্যান্ত জগন্নাথ ঠাকুর করতে বাধ্য হয়েছি তার-ই কি বড়ো কারণ নয় যে আমরা
থার্ড ক্লাসের প্যাসেঞ্জার, তৃতীয় শ্রেণীর যাত্রী, হলদে টিকেট কিনেছি?”—শশাংক
একেবারেই চঞ্চল হয়ে উঠলো, কোন রকমে জানালা দিয়ে লাফিয়ে পড়তে পারলেও যেন মনটা পরম
নিষ্কৃতি পায়। কিন্তু শশাংকর অবস্থা আরও জটিল হয়ে উঠলো, লোকটা শিশুটিকে যথাস্থানে
ফিরিয়ে দিয়ে আবার শশাংকর পাশ ঘেষে বসে উদাসীনভাবে কি ভাবতে লাগলো। তখন তার
সর্বশরীর ঘেমে পাঞ্জাবিটা ভিজে উঠেছে, কাপড়টার নানা স্থানে ধূলাবালি লেগে চ্যাপ্টা
বেধে গেছে—শশাংক লোকটার দিকে তাকিয়ে ঘৃণায় ছটফট করতে লাগলো।
“সিগারেট আছে আপনার কাছে? সঙ্গের বিড়ি
কটা ফতুর হয়েছে। কড়া বিড়ি পেলেই ভালো হতো—তা আপনারা বাবু মানুষ, ওসব জিনিষ
নিশ্চয়ই থাকবে না। সিগারেট যদি থাকেতো তাই একটা দিন—” সিগারেট তার একান্তই
প্রয়োজন এবং সহযাত্রীর কাছে থাকলে অবশ্যই তাকে দিতে হবে। শশাংক কিছু না না বলে
পকেট থেকে একটা সিগারেট বের করে দিল। শশাংক ধন্যবাদ পাবার আশা করেনি, ভাগ্যে তা জুটলোও
না, তবুও পাবার আশংকা করে সে লজ্জিত হয়ে উঠছিল। লোকটা শরীরের শক্তি দিয়ে সিগারেটে
টান দিল, কী অদ্ভুত পিপাসা! সমগ্র বিশ্বসংসারের কারু কাছে যেন তার এতটুকু আব্রু
নেই, তাই আচরণটা নিতান্ত অমার্জিত, নিজের প্রয়োজনটুকুকে নির্লজ্জভাবে আদায় করে
নেয়।
ইতিমধ্যে কী একটা ছোট স্টেশনে গাড়ি
থেমেছে। ফেরিওয়ালারা নানা সুরের হাঁক ডাক করে ছুটোছুটি করছে। শশাংক একটা চা
ওয়ালাকে কাছে ডেকে এক গ্লাস চা হাত বাড়িয়ে আনলো।
“আমাকেও একগ্লাস দেও দেখি হে”—লোকটা
জানালা দিয়ে একটা মাটির গ্লাস এনেই এক চুমুকে সবটা চা শেষ করে দিল। “বড্ড ঠান্ডা হে,
তা থার্ডক্লাসের প্যাসেঞ্জার আমরা—বেশী গরম আর জুটবেইবা কোত্থেকে?” শশাংক
স্তব্ধ হয়ে লোকটার দিকে চেয়ে রইল, হাতের গ্লাসটা মুখে তুলে নেবার শক্তিও যেন তার
নেই। পালিস করা ভদ্র মনটাকে অসভ্য লোকটা অমার্জিত ব্যবহারের ছুরি দিয়ে যেন
রক্তাক্ত করে দিয়েছে। লোকটার হাতের মাটির গ্লাসটা আর শশাংকর হাতের মাটির গ্লাসটায়
যেন কোনও জাতিভেদ নেই, উভয়ই থার্ড ক্লাশের প্যাসেঞ্জারের উপযোগী ঠান্ডা চায়ে
পূর্ণ। নিজের হাতের গ্লাসটার দিকে চেয়ে শশাংকর সমস্ত গাটা ঘিন ঘিন করে উঠলো—থার্ড
ক্লাসের এই অরুচিকর কামরার মধ্যে তার মনটাকে কে যেন হাতুড়ি দিয়ে পিটিয়ে তার-ই
অস্বস্তিকর পরিবেষ্টনের উপযোগী করে তুলেছে। শশাংক হাতের গ্লাসটা তুলে জানালা দিয়ে
ছুড়ে ফেলে দিল।
“একি ফেলে দিলেন যে?’ ব্যাপারটা লোকটার
দৃষ্টি এড়াবার এত-টুকুও ফাঁক পেল না। শশাংক উত্তর দিল, “ঠান্ডা চা আমি খাইনে।”
“ঠান্ডা চা আপনাদের খাবার দরকার-ইবা কি”
লোকটা বলে যাচ্ছিল, “দৈব দুর্যোগে থার্ড ক্লাসে উঠতে হয়েছে। আমাদের তো উপায় নেই,
ঠান্ডা চা দূরে থাক, অনেক সময়ে ঠান্ডা জলও জোটে না। হাঃ হাঃ হাঃ হা” কথা শেষ করে
হাসিতে গলার স্বর ফেটে পড়লো। অথচ এর কোথাও এতটুকু রসিকতা নেই—হাসিটা
থেমে গিয়েও যেন শশাংককে মর্মান্তিক ব্যাংগ করতে লাগলো। রাগে শশাংকের পা থেকে মাথা
পর্যন্ত জালা করে উঠলো, চোখ দুইটা ফেটে বেরিয়ে আসতে চায় যেন, তথাপি শিক্ষা ও
সংস্কৃতি লাগাম টেনে ক্রোধটাকে এতটুকুও প্রকাশ পেতে দিল না। শশাংকর মাথাটা আগুনের
মতো গরম হয়ে উঠেছে, জানালায় মাথা রেখে নিজেকে সে চতুর্দিক থেকে ছিনিয়ে এনে চুপ করে
রইল।
গাড়ি স্টার্ট দিয়েছে। শশাংক জানালা দিয়ে
আকাশের দিকে চাইবার উপক্রম করছিল, লোকটা কথা বলে দৃষ্টি আকর্ষণ করলো, “দেখুন
গাড়িতে বসেই যে কেবল উপলব্ধি করি থার্ড ক্লাসের যাত্রী তা নয়; আমার মনটাতেই যেন
বিধাতা অদৃশ্য হস্তে থার্ড ক্লাসের ছাপ মেরে দিয়েছেন। সে ছাপ আর মুছবেও না—জীবনে
লক্ষপতি হতে পারলেও না, সোনার পালংকে শুয়ে রুপোর বাটিতে চা খেতে পারুলেও না।”
শশাংক অবাক হয়ে চেয়ে দেখলো লোকটার চোখ দুইটা যেন ভিজে উঠেছে। শশাংকর মনে হলো
লোকটার আগেকার অস্বাভাবিক অট্টহাসি যেন বজ্ররবে আগামী বর্ষার সূচনাই ঘোষণা করে
গেছে, কিন্তু আগাগোড়া ঘটনা বিশ্লেষণ করে, শশাংক কোন কারণই খুজে পেলো না, কোথাকার
ঝড়ে মেঘ নেমেছে কে জানে। লোকটা চোখ মুছে পূর্বেকার শিশুটির দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ
করে বলে চল্লো, “এমনি একটি থার্ড ক্লাসের কামরায় আমার অমন সুন্দর একটি শিশু মারা
গেছে। অসুখে নয়—ভিড়ে, লোকের চাপে পড়ে—চোখ দুইটা বড়ো হয়ে ঠিকরে বেরিয়ে এসেছিল—” শশাংক
চেয়ে দেখলো লোকটার বিবর্ণ ঠোঁট দুইটাকে অবলম্বন করে ভাষা কাতড়াচ্ছে; বহুক্ষণের
চেষ্টায় সে সফলকাম হলো, “বায়াত্তরজনের জায়গায় দেড়শো লোকের ভিড়। দেড়শ লোকের সুবিধে
হয়ে যদি সামান্য একটুকও উপচে পড়তো তবে আমার বাছা বাঁচতো। তখন উন্মত্ত হয়ে ভুলে
গিয়েছিলুম আমি থার্ড ক্লাসের যাত্রী, পাগলের মতো দুহাতে ঘুসি ছুড়তে শুরু করেছিলুম।
কিন্তু কতো বড়ো ভুলই না করেছি—থার্ড ক্লাসের যাত্রী আমরা আরও তিনটি শ্রেণীর যাত্রীদের সুযোগ
সুবিধা মিটে গিয়ে যে উৎবৃত্ত জায়গাটুকু থাকবে সেটুকুকে আঁকড়ে ধরে কোন রকমে চলতে
হবে। এ শুধ, ট্রেনে এসেই নয়—ট্রেনের বাইরেও, জীবনের ক্ষেত্রেও। আমরা থার্ড ক্লাস,
প্যাসেঞ্জার।”
কী-একটা জংশনে গাড়ি বদল করতে হবে। আধ
ঘণ্টার জের। শশাংক প্লাটফর্মে নামলো। হৃদস্পন্দনের প্রতিটি শব্দ যেন সে শুনতে
পাচ্ছে—ধমনীর
দ্রুত রক্ত প্রবাহের ধ্বনি তার কানে বেজে উঠছে, স্নায়ুর দুর্বলতায় পা দুটো
মাতালের মতো টলে উঠছে ক্ষণে ক্ষণে। থার্ডক্লাস প্যাসেঞ্জারের বুকের গভীর কান্নার
সুর তার বুকের মধ্যে কেবলি মোচর দিয়ে উঠছে, দুর্বল শরীরটাতে তখনো চলছে গাড়ির নির্মম
ঝাকুনি আর তালে তালে অদ্ভুত লোকটার করুণ অট্টহাসি মনের সমস্ত স্তব্ধতাকে ভেঙেচুরে
ফিরছে, দৃষ্টির পটভূমিকায় ছায়া ফেলছে—একটি ছোট্ট শিশু অসহায় করুণ চক্ষু নিয়ে,
আর কালো ছিপছিপে রহস্য নিবিড় চরিত্রের অদ্ভুত সহযাত্রীর দুই চোখের অবিশ্রান্ত
অশ্রুতে সে ছবিটাকে ভিজিয়ে তুলছে।
সৈন্যাধ্যক্ষরা ইতিমধ্যে সৈন্যবাহিনী
নিয়ে আগেকার গাড়িটাতেই বিদায় নিয়েছে। শশাংক অস্থির অসংবদ্ধ পদক্ষেপে প্রথম শ্রেণীর
কামরা গুলো অতিক্রম করে তৃতীয় শ্রেণীতেই উঠে বসলো।
রচনা :: ৪ জ্যৈষ্ঠ ১৩৪৮