গল্প :: ফজর মিয়া ।। ইব্রাহিম খলিল

ফজর মিয়া।। ইব্রাহিম খলিল

ফজর মিয়া।। ইব্রাহিম খলিল

প্রতিদিনকার মতো আজো খুব ভোরে উঠে শীতে কাঁপতে কাঁপতে ঘর থেকে বের হয়ে গেলো ফজর মিয়া। নিতান্ত অনিচ্ছা সত্বেও প্রতিদিন তার খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠতে হয়, এই বায়ান্ন বছর বয়সেও তাকে টানতে হচ্ছে সংসারের ঘানি। নিজের নাওয়া খাওয়ার দিকে খেয়াল না রাখলেও সংসারের দিকে ঠিকই খেয়াল রাখতে হচ্ছে তাঁকে, তার কারণ হচ্ছে সে ছাড়া দ্বিতীয় কোন উপার্জনক্ষম ব্যাক্তি নেই তার সংসারে, যে তার পরিবর্তে সংসারের ঘানি টানবে। শরীরে কুলোক আর নাই-বা কুলোক তাকে যে কাজ করতেই হবে, সবচেয়ে বড় কথা বেঁচে থাকতে হবেতো। তাইতো শরীরের সব অলসতা এক ঝটকায় ঝেড়ে ফেলে দিয়ে চৌকির কোনায় রাখা গামছাটা নিয়ে ফজর মিয়া হন হন করে খুব দ্রুত বের হয়ে গেলেন ঘর থেকে।

 

এতো ভোরে বের হবার অবশ্য একটা কারণ আছে, আর তা হলো আগের সময় এখন আর নেই, আগে মহাজনদের রিকশা ছিল বেশি আর সেই তুলনায় চালক ছিল কম, তাই সকাল দশটায় গেলেও মহাজনের কাছ থেকে রিকশা নেওয়া যেতো। কিন্তু এখনকার সময় ভিন্ন, এখন রিকশা কম চালক বেশি, তাইতো কাকডাকা ভোরে গিয়ে মহাজনের কাছে ধরনা দিতে হয় রিকশার জন্য। তা না হলে সারা দিনের জন্য রিকশা পাওয়া খুব মুস্কিল হয়ে পড়ে। তাইতো খুব সকালে বের হতে হচ্ছে তাকে। বেঁচে থাকার যুদ্ধে তার জন্য এটা কোন নতুন ঘটনা নয়। প্রতি দিনই সে শিশির ভেজা সকালে বেড়িয়ে পরে, আর আসমা নামের চাঁদের মতো ফুটফুটে ছোট্ট শিশুটি পিতার জন্য প্রতিদিনই ঘুম থেকে উঠে বসে থাকে, পিতার চলে যাওয়া পথের দিকে করুণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে অনেকক্ষণ। এই জীর্ণশীর্ণ শরীরে কুলোবার কথা নয় তার হয়তোবা ফুটফুটে মেয়েটির অকৃত্তিম ভালোবাসাই পিতার দায়িত্ববোধ আরো বাড়িয়ে দিয়েছে ফজর মিয়াকে। হয়তো বা ওই কঁচি মুখের দিকে তাকিয়েই তার শরীর জুড়িয়ে যায় বলেই আজো পরিশ্রম তাকে কাবু করতে পারেনি।

 

এই ছোট্ট ফুটফুটে মেয়েটি তার বড্ড বেশি বয়সে এসেছে। এ নিয়ে হাসাহাসিও করেছে অনেকে, কত কথা শুনতে হয়েছে তাকে, বুড়ো বয়সে ভিমরতি, বুড়ো ভাম, কেউ কেউ বলেছে, কী ফজর মিয়া এইটা কি তোমার ছেলের ঘরের নাতি নাকি? তার পরও তার দুঃখ নেই, যখন ছোট্ট শিশুটি বাজান বলে ডাকে তখন সমস্ত পৃথিবী ফজর মিয়ার কাছে তুচ্ছ মনে হয়, মনে হয় ঐ শিশুটিই তার সব। বলুক না মানুষ যে যার মতো তাতে ফজর মিয়ার কিবা যায় আসে? সে তো আর শিক্ষিত ভদ্র মানুষদের মতো গর্ভপাত করাননি, একটা জীবন শেষ করে দেননি! বলুক যার যা খুশি।

 

কিন্তু আজ কেনো জানি বার বার তার বড় ছেলে মফিজ মিয়ার কথা মনে পড়ে যাচ্ছে। মফিজ মিয়া তার বড় আদরের ছেলে ছিল। মফিজ কে নিয়ে ফজর মিয়ার সংসারটা ছিল সোনায় সোহাগে ভরা। হঠাৎ একটা ঝড় এসে সব কিছু কেড়ে নিলো ফজর মিয়ার কাছ থেকে। দুই বিঘার মতো জমিজমা নিয়ে বেশ আনন্দেই কাটছিলো তাদের সংসার। ফজর মিয়া প্রতিদিন ভোরে চাষ করতো তার নিজের জমি পরম আনন্দে, দশ বারো বৎসরের ছোট্ট ছেলে মফিজ পান্তা ভাতের গামলা মাথায় করে নিয়ে আসতো বাপের জন্য, সে কিজে এক অনুভুতি তা কেবল ফজর মিয়াই জানতো। মাঝে মাঝে মিষ্টি ধমক দিয়ে বাপেরে সে বলতো দেও আমারে দেও,আমি আল চই, তুমি জিরাও, তোমার অনেক বয়স হইছে, এই বয়সে তোমার এতো খাটনি করন লাগবোনা। ফজর মিয়া ছেলের কথা শুনে হাসে আর বলে পাগল পোলা আমার। এমনই হাসি আর আনন্দের মধ্যেই কাটছিলো ফজর মিয়ার দিনকাল, কিন্তু সব কিছু তছনছ করে দিলো সখিনা বিবির মরণব্যাধি। চিকিৎসার জন্য দরকার পড়লো মোটা অংকের টাকা, গতান্তর না দেখে ফজর মিয়া তার সমস্ত জমি বন্ধক রাখলো পাড়ার মোড়লের কাছে। মোড়ল হচ্ছে পাড়ার জমিদার, হয়ে গেলো টাকার বন্দোবস্ত।সেই টাকায় সুস্থ্য হয়ে উঠলো মফিজের মা সকিনা বিবি। তার পর অক্লান্ত পরিশ্রম করে করে বন্ধকের টাকা জোগাড় করে যখন ফজর মিয়া মোড়লের কাছে গেলো তখন, মোড়লের কথা শুনে ফজর মিয়ার মাথায় যেনো আকাশ ভেঙে পড়লো।

 

মোড়ল জানতে চাইলো, ‘কিসের টাকা দিতে চাস রে ফজর?’


ফজর মিয়া বলল, ‘মোড়ল সাব আমার বন্ধকী জমি ছাড়াইয়া নিতে চাই।


মোড়ল বলল, ‘বন্ধকী জমি মানে? তুই তো আমার কাছে জমি বিক্রি করেছিস।’


ফজর মিয়া বলল, ‘কন কী মোড়ল সাব আমি তো আফনের কাচে বন্ধকই রাখছি।’


এই বার মোড়ল আরো শক্ত ভাবে কঠিন গলায় বলে বসলো, ‘এই জন্যই তোগো চাষাভুষাদের সাথে লেনদেন করতে চাইনা, এই দ্যা’ বলে মোড়ল সেই সাদা কাগজের টুকরাটা ফজর মিয়ার দিকে এগিয়ে দিলো যাতে কিনা টাকা নেয়ার সময় ফজর মিয়া টিপসই দিয়েছিলো। ফজর মিয়ার আর বুঝতে বাকি রইলোনা মোড়ল তার সর্বস্ব কেড়ে নিয়েছে।

 

বুকের কষ্ট আর চাপা কান্না নিয়ে নি:স্ব হাতে বাড়ি ফিরে এলো ফজর মিয়া। কয়েক দিনের মধ্যেই মোড়ল ফজর মিয়ার জমির দখল নিয়ে নিলো তার বিশাল লাঠিয়াল বাহিনীর জোরে। অন্যের ক্ষেতে কামলা দিয়ে অর্ধাহারে অনাহারে কাটছে ফজর মিয়ার দিন কাল। এদিকে ফজরের ছেলে মফিজ রাত দিন কামলা খাটছে অন্যের ক্ষেতে, অতিরিক্ত পরিশ্রমের কারনে মফিজ অসুস্থ হয়ে পরলো। এদিকে টানা তিন দিন রান্না হয়নি ফজর মিয়ার সংসারে, তার পর হঠাৎ এক দিন সন্ধ্যা বেলা মফিজ চলে গেলো দুনিয়ার মায়া ছেড়ে। ফজর মিয়ার মনে হলো হয়তো না খেতে পেয়েই ছেলেটি তার মারা গেছে, সেই থেকে ফজর পরিশ্রমকে করে নিলো চিরো সংগী, চলে আসলো ঢাকায়, কোন কাজ না পেয়ে অবশেষে রিকশা চালানো শুরু করলো। অনেক গুলো বৎসর ভুলে ছিলেন তার ছেলে মফিজকে, আসমা নামের এই ছোট্ট মেয়েটার দিকে তাকালে ফজর মিয়া পুরো দুনিয়া ভুলে থাকতে পারে।

 

আজ ফজর মিয়ার শরীরটা একদমই ভালো লাগছেনা, কিছুতেই রিকশা চালাতে মন চাইছে না, কিন্তু চালাতে হচ্ছে এক রকম বাধ্য হয়েই, তার কারণ মহাজনের কাছ থেকে রিকশা নিয়েছে দুই ঘন্টা হয়ে গেছে এখন ফেরত দিলেও পুরো দিনের ভাড়াই দিতে হবে। রোদে গরমে কেমন অতিষ্ট লাগছে তার, কেমন জানি পা দুটো ধরে আসছে, বার বার প্যাডেল থেকে সরে যাচ্ছে তার পা দুটি। কখনো পরিশ্রম কে সে পাত্তা দেয়নি, কিন্তু আজ কেনো জানি মফিজের মুখটা তার সামনে বার বার ভেসে আসছে। মফিজের মিষ্টি ধমকের সুর তার কানে শুনতে পাচ্ছে, বার বার মফিস বলছে বাজান ও বাজান তুমি ঢাহা শহরে রিকশা চালাও, তোমার কষ্ট হয়না? তুমি এতো কষ্ট কইরোনা বাজান আমার খুব কষ্ট হয় তোমার কষ্ট দেখলে। কথা গুলো ভাবতে ভাবতে ফজর মিয়ার ছোট্ট রিকশাটা একটা প্রাইভেট কারের সাথে কখন কিভাবে যে ধাক্কা খেলো তা টেরই পেলোনা ফজর মিয়া, রিকশাটা তার চূর্ণ বিচূর্ণ হয়ে গেলো। চোখের পলকে ফজর মিয়া ছিটকে পড়ে গেল।

Post a Comment (0)
Previous Post Next Post