শরীয়তপুরের গল্পচর্চা: বিষয়-বৈচিত্র্যে অতীত থেকে বর্তমান

শরীয়তপুরের গল্পচর্চা: বিষয়-বৈচিত্র্যে অতীত থেকে বর্তমান

ইয়াসিন আযীয

 

শরীয়তপুরের গল্পচর্চা: বিষয়-বৈচিত্র্যে অতীত থেকে বর্তমান

সাহিত্যর্চ্চায় শরীয়তপুর জেলা বেশ সমৃদ্ধ বলা চলে। পালং থানার ধানুকা গ্রামে মধ্যযুগের ১৬২০ খ্রিস্টাব্দে জন্মগ্রহণ করা বিদূষী নারী কবি জয়ন্তী দেবীসহ অনেকের নাম পাওয়া যায়। যারা বাংলা ও সংস্কৃত ভাষায় সাহিত্য রচনা করেছেন। ধানুকা গ্রামে সংস্কৃত কলেজ বা শিক্ষাকেন্দ্র ছিল বলেও জনশ্রুতি রয়েছে। তবে প্রাচীন সাহিত্যিকদের মধ্যে অধিকাংশ লেখকই মূলত পদ্য লিখেছেন। গল্পচর্চা বা রচনা করেছেন যারাএদের মধ্যে সবার আগে নাম আসে যার, তিনি ঔপন্যাসিক ও গল্পকার অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত।

 

অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত (১৯০৩-১৯৭৬): আইনজীবী বাবা রাজকুমার সেনগুপ্তের কর্মস্থল নোয়াখালীতে ১৯ সেপ্টেম্বর, ১৯০৩ সালে অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্তের জন্ম। বেড়ে ওঠা এবং পড়াশোনা শুরু ওখানেই। তিনি মূলত শরীয়তপুর জেলার পালং থানার দাসার্তা গ্রামের সন্তান। পূজার ছুটিতে বাবার সাথে সপরিবারে আসা হতো গ্রামের বাড়িতে। ১৯১৬ সালে বাবার মৃত্যুর পর তিনি চলে যান কলকাতায় অগ্রজ জিতেন্দ্রকুমার সেনগুপ্তের কাছে। অচিন্ত্যকুমার একজন খ্যাতনামা ঔপন্যাসিক, গল্পকার ও সম্পাদক। অচিন্ত্যকুমার ১৯২৫ সালে কল্লোল পত্রিকা প্রকাশনার দায়িত্ব নেন। তিনি বিচিত্রায়ও কিছুদিন কাজ করেন। রবীন্দ্রনাথ ও শরৎচন্দ্রের পরে কল্লোল যুগের যেসব লেখক সাহিত্যজগতে তুমুল আলোড়ন সৃষ্টি করেছিলেন, তিনি তাদের মধ্যে অন্যতম। একাধিকবার লেখা পাঠিয়েও প্রকাশিত না হলে, মজার ছলে ‘নিহারিকা দেবী’ নারী ছদ্মনামে লেখা পাঠালে ১৩২৮ বঙ্গাব্দে ‘প্রবাসী’ পত্রিকায় তার প্রথম লেখা (কবিতা) প্রকাশিত হয়।

তিনি ইংরেজি সাহিত্যে অনার্সসহ বিএ পাস করেন। এরপর এমএ ও বিএল পাস করে ১৯৩১ সালে মুনসেফ পদে কর্মজীবন শুরু করেন। পরবর্তীকালে সাব-জজ ও জেলা জজ এবং ল কমিশনের স্পেশাল অফিসার পদে উন্নীত হয়ে ১৯৬০ সালে অবসরে যান। বিচার বিভাগে চাকরির সুবাদে বাংলার বিভিন্ন জেলায় চাকরি করতে তাকে বহু জায়গায় ঘুরতে হয়েছিল। শহরের কানাগলি থেকে প্রত্যন্ত গ্রামের মেঠোপথে ঘুরে খুব কাছ থেকে প্রকৃতি এবং বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের সংস্পর্শে এসে বিচিত্র সব অভিজ্ঞতা অর্জন করেন। সে সব জীবনঘনিষ্ঠ, অন্তরঙ্গ নানা চালচিত্র অচিন্ত্যকুমার তার ছোটগল্পে নিখুঁত ও সুনিপুণভাবে তুলে এনেছেন। উপন্যাসে যেমনি ‘বেদে’ ছোটগল্পে তেমনি ‘দুইবার রাজা’ এবং পরবর্তীকালে ‘অরণ্য’ তাকে খ্যাতি এনে দেয়। ‘টুটাফাটা’ (১৯২৮) তার প্রথম গল্পগ্রন্থ। ‘অকাল বসন্ত’ (১৯৩২) ‘অধিবাস’ (১৯৩২) ‘যতনবিবি’ (১৯৪৪) ‘কাঠ-খড় কেরোসিন’ (১৯৪৫), ‘চাষাভূষা’ (১৯৪৭), ‘সারেঙ’ (১৯৪৭) ‘হাঁড়ি মুচি ডোম’ (১৯৪৮) ‘একরাত্রি’ (১৯৬১) ইত্যাদি তার উল্লেখযোগ্য গল্পগ্রন্থ।

অচিন্ত্যকুমারের গল্পে অসংখ্য চরিত্রের ভিড়ে মুদি দোকান চালানো বিহারি মেয়ে গুড়িয়া, চাষি আমানত আলী, গায়িকা শেফালি, হাঁপানি রোগী অমর, পেশাদার সাক্ষী দুর্লভপ্রত্যেকেই নিজস্ব স্বাতন্ত্র্যে ভাস্বর। দুটি বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী হতাশা, আদর্শের অভাব প্রভৃতি যুগলক্ষণ তার গল্পের পাতায় পাতায় মিশে রয়েছে। খেটে-খাওয়া সাধারণ মানুষের জীবনালেখ্য তার রচনার মুখ্য বিষয়বস্তু। স্বতন্ত্র গল্পভাবনার জন্য বিষ্ণু দে অচিন্ত্যকুমারকে ‘আর্নেস্ট হেমিংওয়ে’র সঙ্গে তুলনা করেছেন। ন্যুট হ্যামসুন, হেলেন কেলার ও পান্তারনাকের রচনা বাংলায় অনুবাদ হয়েছে তার হাত ধরেই। ‘আধুনিক সোভিয়েট গল্প’ (১৯৪৪) তার উল্লেখযোগ্য অনুবাদ গল্পগ্রন্থ। গ্রন্থটিতে ১৭টি অনুবাদ গল্প স্থান পেয়েছে। ১৯৭৬ সালের ২৯ জানুয়ারি অচিন্ত্যকুমার কলকাতায় মৃত্যুবরণ করেন।

 

স্বর্ণকমল ভট্টাচার্য (১৯০৮-১৯৬৪): পালং থানার বালুচরা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি বহু ছোটগল্প লিখেছেন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য গল্প হচ্ছেমন্তশক্তি, পিঠাপিঠি, সমান্তরাল, ইতর, হাতেখড়ি, কালীয়দমন, অকাল বোধন, গঙ্গাজল, অকৃতজ্ঞ, বধু, নাছোড়, দরদী, গল্প নয়, ওঝা, বাজিকর, পোস্টার, বন্দিনী, উত্তর পুরুষ ইত্যাদি। গল্পগুলো তিনি ‘সবার সাথে’ (১৩৪৬) ও ‘ছোট বড় মাঝারি’ (১৩৫৭) নামের দুটি গ্রন্থে মলাটবদ্ধ করেন। স্বর্ণকমল যখন কলম হাতে নিয়েছিলেন তখন বিশ্বজুড়ে চলছিল অরাজকতা, সাম্রাজ্যবাদ ও ফ্যাসিবাদের সাঁড়াশি আগ্রাসন। ফলে তিনি প্রগতিবাদী লেখক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন। তাছাড়া ভট্টাচার্য দু-দুটি বিশ্বযুদ্ধ, ভয়ংকর কঠিন দুর্ভিক্ষ বা মন্বন্তর, মানবাধিকার লংঘন, দাঙ্গা, স্বাধীনতা লাভ, দেশভাগ প্রভৃতি চাক্ষুষ প্রত্যক্ষ করেন। ফলে বিষয়গুলো তার গল্পে গভীরভাবে প্রভাব বিস্তার করেছে। তার ‘মন্তশক্তি’ নামক ছোটগল্পে জমিদারবিরোধী তেভাগা আন্দোলনকে আশ্রয় করে বিন্যস্ত। গল্পের কেন্দ্রীয় চরিত্র ‘রসুল’ রাতের অন্ধকারে অন্যের বাড়িতে সিঁদ কাটে। রসুল আদতে তার হতদরিদ্র পরিবারের জন্য অন্ন জোগাতে এই কাজ করত। কিন্তু রসুল দিনে চোর থেকে বিপ্লবীতে রূপান্তরিত হয়ে জমিদখলের লড়াইয়ে সবার সঙ্গে মোটা লাঠি হাতে বেড়িয়ে পড়ে। তার ‘ওঝা’ গল্পটি ৪৬ সনের হিংস্র দাঙ্গার প্রেক্ষাপটে রচিত। প্রধান চরিত্র কলকাতার প্রতিষ্ঠিত অধ্যাপক। যারা অন্যের কাঁধের ভূত তাড়ায়, তারাই ওঝা। কিন্তু এই গল্পে ওঝা মশাই অপরের ভূত ছাড়ানোর দায়িত্ব নিয়ে নিজেই পড়েন ভূতের পল্লায়। নিজের অবচেতনে ভূত তাকেই তাড়া করেছিল। ‘পোস্টার’ গল্পটি কথকের মাধ্যমে লেখকের একটি ব্যতিক্রমী উপস্থাপনা। সাধারণত পোস্টারে লেখা হয় বিভিন্ন আন্দোলনের স্লোগান। পটভূমি ফ্ল্যাটবাড়ি অধ্যুষিত কলকাতা শহর এবং একজন ছাপোষা ছোটখাটো কেরানি। ‘ছাঁটাই করা চলবে না’; ‘জমিদারি প্রথার উচ্ছেদ চাই’; ‘বিদেশী মূলধন বাজেয়াপ্ত কর’ প্রভৃতি স্লোগান কীভাবে সংগ্রামের পথে মানুষকে উদ্বেলিত করে, তা-ই এই গল্পে দেখানো হয়েছে। ‘কালীয়দমন’ গল্পটিতে সচিত্রিত ও বিকশিত যৌনভাবনার ধ্রুব দিক। মাত্র সাত মাস স্থায়ী হয় প্রধান চরিত্র ‘অতসী’র দাম্পত্য জীবন। বিয়ের দশবছর অতিক্রান্ত হলেও তার বয়স মাত্র তেইশ। একদিকে ‘অতসী’র প্রয়াত স্বামীর প্রতি একনিষ্ঠতা ও কল্পনায় ফিরে আসা; অন্যদিকে প্রেমিক ও ভালোবাসার পাত্র যতীন ঘোষালের পাগল করা আকর্ষণে মোহাচ্ছন্ন। চেতন-অবচেতনের দ্বন্দ্বকে কথাকার এখানে বাস্তবায়ন করেছেন কালজয়ী ভাবনায়।

 

সাবিত্রী রায় (১৯১৮-১৯৮৫): জন্ম ঢাকায়। পৈতৃক নিবাস বালুচরা, পালং, শরীয়তপুর। তিনি মূলত একজন ঔপন্যাসিক। ভাবসর্বস্ব রোমান্টিকতাকে পরিহার করে তিনি রাজনৈতিক ও সামাজিক সমস্যার গভীরে প্রবেশ করে তার লেখালেখি শুরু করেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ কালে। প্রথম অনুবাদ গল্প ‘চোখের জল ফেলো না মারিয়ানা’ প্রকাশিত হয় ১৯৪৪ সালের ২৯ ডিসেম্বর ‘অরণি’ পত্রিকায়। সাবিত্রী রায়ের ব্যক্তি জীবনের অভিজ্ঞতাই তার গল্পের চরিত্রের মূল উপাদান। সংসার সুখের করতে চাকরি ছেড়ে দেওয়া, সন্তান পালন, অসুস্থতা, মতাদর্শগত বিরোধসবই কোনো না কোনো ভাবে প্রভাবিত করেছে তার সৃষ্ট চরিত্রে। মারিয়ানা’র সঙ্গে হয়তো তার জীবন মিলে গিয়েছিলতাই তিনি অনুবাদ করেছিলেন গল্পটি। পরবর্তীকালে ১৯৪৫ সালে প্রথম মৌলিক গল্প ‘ধারাবাহিক’ প্রকাশিত হয় একই পত্রিকায়। ওই বছরে অরণিতে তার ‘মাটির মানুষ’, ‘নূতন কিছু নয়’, ‘সাময়িকী’, ‘ওরা সব পারে’ ইত্যাদি গল্পসমূহ প্রকাশিত হয়। উপরোক্ত গল্পসহ ‘রাধারাণী’ (১৯৪৫), ‘স্বর্গ হইতে বিদায়’ (১৯৫৬), ‘সমঝদার’ (১৩৫৭), ‘হাসিনা’ (১৯৪৭), ‘প্যারামবুলেটার’ (১৯৪৮), ‘অন্তঃসলিলা’ (১৯৪৯) প্রভৃতি গল্প নিয়ে ১৯৫২ সালে প্রকাশিত হয় সাবিত্রী রায়ের একমাত্র গল্পসংকলন ‘নূতন কিছু নয়’। এর পর গল্পকে বড়ো করে করে দু-তিন খণ্ডে লিখেছেন মোট ন’টি উপন্যাস। উপন্যাসে তিনি জমিদারের ধামাধরা জগাই বাড়ুজ্জের বিরুদ্ধে পাহাড়পুরের সাধারণ মানুষের সংগঠিত প্রতিরোধের ছবি এঁকেছেন অনমনীয় ঋজুতায়। সেই কলমই যেন ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে ছোটগল্পেযেখানে মন্বন্তরের পরের কলকাতায় বিরাট অভিজাত বাড়ির নর্দমা দিয়ে গড়িয়ে আসা ফ্যান আর তার সঙ্গে মিশে থাকা কয়েকটা ভাতের জন্য কামড়াকামড়ি করে ক্ষুধার্ত মানুষ। পেটের জ্বালা বড় জ্বালাকাজের মেয়ে গোলাপি যে ক’টা ভাত পায় নিজেই খেয়ে ফেলে, স্বামীকেও দেয় না। পূর্ব বাংলার গ্রামের সম্পন্ন বাড়িতে সারাজীবন সেবা দেওয়া বুড়ি পরিচারিকাকে রেখেই ‘ইন্ডিয়া’ রওনা দেয় সবাই। যে ছেড়ে যায় আর যাকে ছেড়ে যাওয়া হয়, এই দুই অসহায় মানুষের জন্যই ভালোবাসা ঝরে পড়ে সাবিত্রীর কলমে। প্রগতিশীলতার মুখোশ কীভাবে খসে পড়ে কফি হাউসের টেবিলে, কিংবা একজোড়া দুল হারালেতা তিনি দেখিয়েছেন ‘অন্তঃসলিলা’ ও ‘ওরা সব পারে’ গল্পে। তার গল্পের মধ্য দিয়ে তিনি খোঁজ করেছেন, বামপন্থী পরিবারেও কেন সামন্ততান্ত্রিক নারীভাবনা স্থান পায়, কেন পর্দার আড়ালে থাকা নারী, পুরুষের সহযোদ্ধা হতে পারে না। তিনি লিখতে শুরু করেন, নিজের দৈনন্দিন আনন্দ, হতাশাআশাভঙ্গের কথা। নিজের চারপাশে যা দেখতে পাচ্ছিলেন, সেই কথার মধ্যেই মিশে থাকছিল নিজস্ব ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার কথাও। তার গল্পের চরিত্র শকুন্তলা দেবীর মতোই নিভৃতে, পানের পিক আর সর্দি-বসা পাকা কফ লাগা দেওয়াল পেরিয়ে সরু গলির মধ্যে স্যাঁতসেঁতে বাড়ি যার ঠিকানা; জ্বরার্ত শিশুর পরিচর্যা, রান্না, দেবর-শাশুড়ির বিদ্রূপ আর স্বামীর উদাসীনতা সয়েও যিনি লিখে যান।

 

রথীন্দ্রকান্ত ঘটক চৌধুরী (১৯২১-১৯৮৮): জন্ম পালং থানার দক্ষিণ বালুচরা গ্রামে। তিনি মূলত কবি ও প্রাবন্ধিক। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্নেহধন্য ছাত্র হিসেবে পড়েছেন শান্তিনিকেতনে। ছাত্রাবস্থায় তিনি শান্তিনিকেতন সাহিত্য সংস্থা ‘সাহিত্যিকা’র সম্পাদক হিসেবেও কৃতিত্ব দেখান। তিনি সমাজসেবা ও পিছিয়ে পড়া মানুষের মাঝে শিক্ষা বিস্তারে ব্রতী ছিলেন। তাই লেখার সময় পেয়েছেন কম। তবুও তার লেখা নিছক কম নয়। তবে যা লিখেছেন তার বেশির ভাগই অপ্রকাশিত। তার একমাত্র গল্পগ্রন্থ ‘ঝরাপাতা’ প্রকাশিত হয় ১৯৮৮ সালে তার মৃত্যুর বছর। তিনি মোট একশ পঁচিশটি ছোটগল্প রচনা করেন বলে জানা যায়। প্রবাসী, ভারতবর্ষ, দেশ, অরণী, অগ্রণী, যুগান্তর, আনন্দবাজার, বসুমতি, পরিচয়, সওগাত, দৈনিক বাংলা, সংবাদ, ইত্তেফাক, জনতা, সন্ধানী প্রভৃতির মতো বিখ্যাত সব পত্রিকায় তার লেখা প্রকাশিত হয়েছে। একশত পঁচিশটি গল্প লেখা সত্ত্বেও রথীন্দ্রকান্তকে কবি ও প্রাবন্ধিক হিসেবে পরিচয় করিয়ে দেওয়াবোধকরি তার প্রতি অবিচারই হয়েছে। এর কারণও আছে বৈকি। তার একমাত্র গল্পগ্রন্থ ঝরাপাতায় স্থান পেয়েছে মাত্র এগারোটি গল্প। গল্পগুলো হচ্ছে-ঝনটুকুলির বাঁশি, পদ্মবিড়ি, প্রতিধ্বনি, দ্বিভুজ, থার্ডক্লাস প্যাসেঞ্জার, পটভূমিকা, আহত, রাতের আয়নায়, ক্ষুরধার, দুই বিন্দু ও চেরাগ। প্রথম গল্প ঝনটুকুলির বাঁশিতে—‘রাত্রি নিস্তব্ধ হইলেই কনটুকুলির বাঁশি বাজিয়া ওঠে। জীবনের সুখ-দুঃখের মুহূর্তগুলি সুরের প্লাবনে কোথায় যেন ভাসিয়া যায়।’ বাঁশিবাদক ঝনটুকুলি কী এক ঘোরে বাঁশি বাজায়, গল্পের বাবুও আচ্ছন্ন হয়ে শুনতে থাকে। গল্পটি পড়তে বসে আমাকেও পেয়ে বসে তাদের আচ্ছন্নতায়। কী এক ঘোরের মাঝে যেন হারিয়ে গেলাম! সেই আচ্ছন্নতা আমাকে মুহূর্তেই গল্পের শেষ অবধি টেনে নিয়ে গেল। আমি একের পর এক গল্প শেষ করতে লাগলামথার্ডক্লাস প্যাসেঞ্জার, পটভূমিকা, আহত, রাতের আয়নায়র মতো উল্লেখযোগ্য গল্পগুলো। ঝরঝরে মেদহীন বাক্যে সাজানো নাতিদীর্ঘ (দুই একটি ব্যতিক্রম ছাড়া) গল্পগুলো পড়তে শুরু করলে কখন শেষ হয়ে যায় টের পাওয়া যায় না। রথীন্দ্রকান্তের গল্পে গাঁয়ের একেবারে প্রান্তিক নিম্নশ্রেণির বিভিন্ন পেশার মানুষের জীবনসংগ্রাম মুখ্য বিষয় হয়ে উঠে এসেছে।

আমরা যাত্রাপথে এরকম কিছু সহযাত্রী পেয়ে যাইযারা বাঁচাল, গায়ে পড়ে কথা বলতে আসে। অতিরিক্ত রকমের মিশুক, সিগারেট সেধে খায়। লোকগুলোর ভাবসাব এমন থাকে যেনকতদিন ধরে চেনে। থার্ড ক্লাস প্যাসেঞ্জার গল্পটিকে ঠিক ওরকম গতানুগতিক মনে হয়েছিল। সৈন্যবিভাগের বড় কর্তারা সদলবলে ফার্স্ট ক্লাস আর সেকেন্ড ক্লাসের কামরাগুলো দখল করে নিলে সুসভ্য বেশভূষার শশাংক স্যুটের নিচে অভিজাত মনটা ঢেকে রেখে, নিরুপায় হয়ে বাহাত্তর জনের কামরায় শ’খানেক যাত্রীর মধ্যে গাদাগাদি ভিড়ে শংকিত চিত্তে থার্ড ক্লাসে উঠে বসে। এরই মধ্যে লম্বা কালো ছিপছিপে চেহারার এক লোক, একটি পুঁটলি নিয়ে গাড়িতে ওঠে। যার গায়ের জামাটা ঘামে ভেজা ও দুর্গন্ধযুক্ত, দৃষ্টিতে উগ্ররকমের ঔৎসুক্যবিনয়ের বিন্দুমাত্র বালাই নেই। যার সংকোচের আব্রুতে কোথাও কথা বাধা পায় না। এমন অদ্ভুত লোক শশাংক জীবনে দেখেনি। লোকটার উৎসুক দৃষ্টি থেকে বাঁচতে শশাংক দেহকে সংকুচিত করে মনটাকে যথাসাধ্য উদাসীন করে তুলবার জন্য জানালা দিয়ে যতদূর যায় গলা বাড়িয়ে দিল। কিন্তু লোকটা তার চৌদ্দগোষ্ঠীর গল্প জুড়ে দিল; শুধু তাই না—‘আমাদের মতো গরীব ছোটলোক থার্ড ক্লাস যাত্রীদের এরকম কষ্ট সহ্য করেই যেতে হয়’এরকম অনেক নীতিবাক্যে কামরা ভরিয়ে তুলছিল। গরম আর লোকে গিজগিজ করা কামরায় এরই মধ্যে একটি ছোট্ট শিশু কান্না জুড়ে দিল। কোনোভাবেই থামছে না। লোকটি বাচ্চাটিকে তার কাছে এনে গ্রাম্য বিভিন্ন ছড়া খৈ-এর মতো আওড়াতে থাকলে বাচ্চাটি কান্না থামিয়ে দেয়। লোকটি বাচ্চাটিকে ওর মায়ের কাছে দিয়ে জানায়তার একটি বাচ্চা একদিন এরকম একটা থার্ড ক্লাস কামরায় ভিড়ের চাপে মৃত্যুবরণ করেছিল। লোকটি বিবর্ণ ঠোঁটে ছেলের করুণ মৃত্যুর বর্ণনা করে। তারপর বলতে থাকে—‘...থার্ড ক্লাসের যাত্রী আমরাআরও তিনটি শ্রেণীর যাত্রীদের সুযোগ সুবিধা মিটে গিয়ে যে উদ্বৃত্ত জায়গাটুকু থাকবে সেটুকুকে আঁকড়ে ধরে কোনো রকমে চলতে হবে। এ শুধু ট্রেনে এসেই নয়ট্রেনের বাইরেও, জীবনের ক্ষেত্রেও। আমরা থার্ড ক্লাস প্যাসেঞ্জার।'

লোকটির শেষের দিকের কথাগুলো যাত্রাপথের গতানুগতিক অন্যান্য গল্প থেকে ‘থার্ড ক্লাস প্যাসেঞ্জার’ গল্পটিকে আলাদা করতে বাধ্য করেছেন লেখক। যাই হোক একটি জংশনে আধঘণ্টার জন্য ট্রেন থামলে শশাংক প্লাটফর্মে নামে। ছোট্ট শিশুর অসহায় করুণ চক্ষু, কালো ছিপছিপে রহস্য  নিবিড় চরিত্রের অদ্ভুত সহযাত্রীসহ থার্ড ক্লাস প্যাসেঞ্জারের বুকের গভীর কান্নার সুর তার বুকের মধ্যে কেবলই মোচড় দিয়ে উঠছে...। সৈন্যবাহিনী ইতোমধ্যে বিদায় নিলেওশশাংক অস্থির অসংবদ্ধ পদক্ষেপে প্রথম শ্রেণীর কামরাগুলো অতিক্রম করে তৃতীয় শ্রেণীতেই উঠে বসলো।’

‘ঝরাপাতা’ গল্পগ্রন্থের ছয় ও সাত নম্বর গল্প ‘পটভূমিকা’ ও ‘আহত’। দুটি গল্প মিলেমিশে একাকার। মনে হয়েছে একই গল্পের দুটি অংশ। ‘ঝরাপাতা’র প্রতিটি গল্পের শেষে তারিখ উল্লেখ রয়েছে। তারিখ থেকে দেখা যায় ‘পটভূমিকা’ ও ‘আহত’ গল্প দুটি বাংলা ১৩৫১ সনে রচিত। ১৩৫০ বঙ্গাব্দে (১৯৪৩ খ্রি.) দুর্ভিক্ষ হয়েছিল। যাকে আমরা ‘পঞ্চাশের মন্বন্তর’ বলে জানি। দুই বাংলায় দুর্ভিক্ষের করাল থাবা ছিল সবচেয়ে করুণ। লেখকের নিজ গ্রাম বালুচরা এবং আশপাশের এলাকায় দুর্ভিক্ষ এবং দুর্ভিক্ষ পরবর্তী সময়ের কাহিনী তুলে ধরেছেন লেখক গল্প দুটিতে। ‘পটভূমিকা’ গল্পটি শুরু হয়েছে ঠিক এভাবে—‘হতশ্রী বালুচর গ্রাম। শিরদাঁড়া বার করা বাড়িগুলো এক রকম জন-মানব পরিত্যক্ত। দুর্ভিক্ষের আগুনে কারো খসেছে অর্ধেক চালাকারো সমন্তটাই আর কারো বা বাড়িঘর সব। সন্ধ্যার পরে গ্রামটার বুকে যেন চেতনা থাকে নাশিরাগুলি নিস্তেজ। সকলের চিন্তা একই, সমস্যা আগামীকালের অন্ন সংস্থান।’ পুবধারের কালীর ভিটায় তখনো পঞ্চাশের না-খেয়ে মরা মানুষের হাড়ের স্তূপ পড়ে আছে। দুর্ভিক্ষের আগুনের পর গ্রাম জুড়ে শুরু হয়েছে ম্যালেরিয়া, কালাজ্বরের মহামারির আগুন। সে সময় নলকূপ ছিল না। মানুষ পুকুরের পানি পান করতো। তাও পানা আর আগাছা পঁচে বমি-ধরা দুর্গন্ধ ভাসছে বাতাসে। ধান পেকে আছে মাঠে। কৃষকরা হী-হী করে কাঁপছেহাত থেকে খোসে পড়ে কাস্তে। শক্ত জোয়ান মানুষগুলো গোড়াকাটা গাছের মতো লুটিয়ে পড়েছে মাটিতে। এরই মধ্যে একটি চিকিৎসা সাহায্যের দল রাজধানী থেকে গ্রামে আসে। যা দেখে—‘মুহূর্তে যেন গা মোড়ামুড়ি দিয়ে গ্রামটা চোখ মেললোধুক ধুকে হৃদপিণ্ডে আবার এলো স্পন্দন। আশার আলোয় পাংশু বিবর্ণ মানুষগুলোর কটোরগত চোখগুলি যেন ঝিকমিক করে ওঠে নতুন শক্তিতে।’ ফলে বালুচরা গ্রামসহ আশপাশের বিভিন্ন গ্রাম থেকে জীর্ণশীর্ণ হাড় বের করা পেট সর্বস্ব চেহারার মেয়ে পুরুষ শিশু বৃদ্ধ; হিন্দু-মুসলমান-চাষি-মধ্যবিত্ত হাতে হাতে রং বেরঙের নানা মাপের শিশির বোতল হাতে রোগীর মিছিল লাইনে দাঁড়ায়।

‘পটভূমিকা’ গল্পটি যেখানে শেষ হয়েছে ‘আহত’ গল্পটি যেন ঠিক সেখান থেকেই শুরু হয়েছে। নিরঞ্জন অধিক রোজগারের আশায় কলকাতায় পাড়ি দিয়েছিল। রেখে গিয়েছিল প্রিয় গ্রাম, নিজের এবং মনের মানুষ সুশীলাদের পরিবার। কলকাতায় বসে সে মায়ের চিঠি মারফত অনেক খবর জানতে পেরেছে। দুর্ভিক্ষে না খেয়ে এবং দুর্ভিক্ষ পরবর্তী মহামারিতে নিতাই সুতারের পরিবারের মতো অনেক পরিবারই মারা গেছে। পাশাপাশি সে দেখেছে কলকাতার রাস্তায় কাতারে কাতারে নরকংকালের মিছিলফুটপাতের উপর অগণিত শবএকটু ফ্যানের জন্য বুকফাটা কান্না। নিরঞ্জন ভেবেছিলগ্রামের অবস্থা হয়তো এতটা মর্মান্তিক নয়। কিন্তু বিভিন্ন মাধ্যমে সে জেনেছেদেশের সর্বত্রই প্রতিদিন না খেয়ে হাজার হাজার লোক মারা যাচ্ছেশহর আর পল্লিতে তফাৎ নেই। নিরঞ্জন প্রায় দুই বছর পরে তার নিজ গ্রামে ফিরে গ্রামের পরিবর্তন দেখে অবাক হয়। গ্রামের মানুষের পরিণতিসহ তার মনের মানুষ সুশীলা এবং তার পরিবারের করুণ পরিণতি দেখে হোঁচট খেয়ে চিন্তাসূত্র ছিঁড়ে যায় নিরঞ্জনের। তবুও সান্ত্বনা হীরুভূমালীর মেয়র মতো কুলত্যাগ করে অন্যত্র চলে যায়নি সুশীলা।

‘রাতের আয়নায়’ রথীন্দ্রকান্তের আর একটি কালোত্তীর্ণ গল্প। গল্পটির রচনাকাল বাংলা ১৩৫৫ সন। আগের দুটি গল্পের ধারাবাহিকতার পরের গল্প এটি। এখানে দুর্ভিক্ষ ও মহামারির পরে দেশভাগ ও দেশভাগ পরবর্তী স্থানীয় হিন্দুদের দলে দলে ভারত চলে যাওয়া, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির বর্ণনার পাশাপাশি মজুতদার ও ধর্মীয় লেবাসধারীর মুখোশ উন্মোচিত হয়েছে এ গল্পে। হাশিম কেরায়া নৌকা চালায়। কিন্তু ইদানীং হর-হামেশাই বেকেরায়া দিন যাচ্ছে। একটাকা আট আনার রুজিতে কী করে সংসার চালাবে সে। ‘তার ওপর জিনিসের দরতো বেড়েই চলেছে দিনের পর দিন। আর পাঁচটার কথা না হয় ছেড়েই দিল, শুধু যে নুন দিয়ে চারটা ভাত খাবে তারই কি কোন উপায় আছে। চাউলের মণ কুড়ি টাকা থেকে লাফিয়ে লাফিয়ে পঁয়ত্রিশে উঠেছেকদিন বাদেই তো চল্লিশ পঞ্চাশ হলো বলে।’ হাশিম তার মতোই আরেক কেয়ারার মাঝি আমিনউদ্দিনকে ডাকে, তার থেকে ধার করে এক ছিলুম তামাক সাজিয়ে আগুন ধরায়; তারপর দুজনে বসে টানে। কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে হাশিম, তারপর অসংলগ্নভাবে হঠাৎ বলে ওঠে—‘আইজতো এ্যাকটা কেরায়াও পাইলাম না।’ একটা বুকভাঙা দীর্ঘনিশ্বাস তার কথার শেষের দিকটায় মিলিয়ে যায়। উত্তর খুঁজতে কিছুক্ষণ হাতড়ায় আমিনউদ্দিন, তারপর বলে, তা আর কী কইমু, ভাইদিনকাল বড় খারাপ পড়ছে। পঞ্চাশ সনের থেইকাও বড় আকাল আইব বুঝি এইবার।’ নোয়াখালী, কলকাতায় দাঙ্গা-হাঙ্গামা দেশ-ভাগাভাগি, হিন্দুস্থান-পাকিস্তান ঘরবাড়ি বেচে দলবেঁধে হিন্দুদের দেশ ছেড়ে চলে যাওয়ায়আকাল; কোথা দিয়ে কেন যে কীভাবে কী হলো কিছুই বুঝে উঠতে পারে না হাশিম-আমিনউদ্দিন। হিন্দুরা গিয়াই আমাগো খাইয়া গ্যাছে। কেরায়ার লোক কী আর দেশে আছে?’ অবশেষে হাশিম বাড়ির দিকে ফিরে যেতে উদ্ধত হয়; এরই মধ্যে পিছন থেকে কেউ একজন ডাকে—‘কেরে? কেয়ারা যাইতে পারবিকদমপুরের হাটে।’ লাফিয়ে উঠে দাঁড়ায় হাশিম। দেখে বাজারের বড়ো মহাজন শ্রীনাথ কুণ্ডু ছাতা বগলে রাস্তার উপর দাঁড়িয়ে নৌকা খুঁজছে। এমন অপয়া দিনে শ্রীনাথ কুণ্ডুকে দিয়েই তার প্রথম বাউনি। ওই দিকে বউ বাচ্চা হয়তো না-খেয়েই আছে চালের অভাবে। তাই কদমপুরের হাটে এক টাকার প্রস্তাবে একরকম বিনা ওজর আপত্তিতেই রাজি হয়ে যায় হাশিম। ঘাট থেকে নৌকা ছেড়ে পাকা মাঝির ক্ষিপ্রতায় লগি চালায় হাশিম। মেঘ সরে যাওয়া আকাশের মতো হালকা হয়ে যায় তার মনটা প্রসন্নতা উপচে পড়ে চোখে মুখে। ‘আপনারাও পাকিস্তান ছাইড়্যা চইল্যা যাইবেন নাকি কত্তা; সকলেই তো চইল্যা গেল’। ‘সক্কলে যাইলেই কি আর আমরা যাইমুরেবুঝোচনা হুজুগ সব হুজুগ’রাশভারি গলায় উত্তর দেয় শ্রীনাথ কুণ্ডু। হাটে নেমে ঘুরে ঘুরে সারি সারি দোকান দেখে হাশিম। আর মনে মনে ঠিক করেকুণ্ডু মশাইয়ের কাছ থেকে কোয়ারার টাকাটা অগ্রিম চেয়ে নিয়ে হাট থেকেই একসের চাল কিনে নেবে হাশিম। বাদবাকি পয়সা দিয়ে ছেলে হামিদের জন্য একগাছা লাল তাগা নেবেই সে আজ। যে লালতাগা আনার কথা রোজ রোজ বলে বলে হয়রান হয়ে এখন আর বলে না হাশিমের স্ত্রী আমিনা। তাই সাহস করে মাথা চুলকাতে চুলকাতে হাশিম বলে, ‘যদি কিছু মনে না করেন কত্তা তবে কই।’ কুণ্ডু অভয় দিলে হাশিম সবিনয় বলে, ‘চাইতে তো আর পারি না নিজের থেকে খুশি হইয়া টাকাটা যদি অখন দিতেন তবে হাটের থেইক্যা কিছু খোরাকির চাউল কিন্যা নিমু ভাবছি। এইখানে চাউলের দাম আমাগো গ্রামের থেইক্যা সম্ভা কিনাটাকায় এই ধরেন সোয়াসের।'কত্তা কৌশলে হাশিমকে থামিয়ে দেয়—‘চাউল কিনবি সেই কথা ক; সেইয়ার লেইগ্যা আবার ভাবনা কি। চাউলতো দোকানের লেইগা আমিই নিমুবাজারে গিয়া সেইখান থেইকাই নিতে পারবি।’ হাশিম সবগুলো চালের বস্তা নৌকায় তোলে। ভারি ভারি বোঝাগুলির চাপে শিরদাঁড়া যেন ভেঙে আসতে চায় একেকবার। বেশ একটু রাতে হাশিমের চাল বোঝাই নৌকা এসে বাজারের ঘাটে আসে। সারাদিনের উপোসে রোদেপোড়া পরিশ্রমে এলিয়ে পড়া দুর্বল শরীর নিয়ে চালের বস্তাগুলি একে একে শ্রীনাথ কুণ্ডুর দোকানে তুলে দিয়ে হাশিম যখন খালাস হলোতখন তার এক পা চলবার আর সামর্থ্য নেই। দোকান ঘরের কোণে একটা খুঁটিতে ঠেস দিয়ে বসে সে খানিকক্ষণ চোখ বুজে থাকে। হঠাৎ কড়কড় মড়মড় শব্দে খুলে যায় দোকান ঘরের ভেজানো টিনের ঝাপটা। সেই দিকে দৃষ্টি যেতেই চমকে ওঠে হাশিম; টিমটিমে প্রদীপের অস্পষ্ট আলোতে তার ঝাপসা চেতনায় একটা অদ্ভুত রহস্যময় মনে হয় যেন সব কিছু। ভারি ভারি পায়ের শব্দে কেউ একজন কুণ্ডুর গদিতে উঠে, খাটো গলার প্রশ্ন করে ‘কতমণ চাউল খরিদ কইর‍্যা আইলেন?’ ‘ত্রিশ মণ চৌত্রিশ টাকা দরে।’ কুণ্ডু উত্তর দেয়। বেশ বেশউল্লাসে লাফিয়ে ওঠে সেই চাপা ভারি গলাটা। ‘এইখানে আইজ এক বিকালের মধ্যেই দর চল্লিশ টাকায় ওঠছে। কাইল আরো দুই একটাকা বাড়বে আশা হয়।’ একটা জঘন্য ষড়যন্ত্রের আভাস পায় হাশিম ভেজানো দরজার অবরুদ্ধ ঘরটার মধ্যে। ‘কাল সন্ধ্যার মধ্যে সন্তায় পঁয়ত্রিশ মণ নিরস চাউলের জোগার করতে হইব আপনেরযত সম্ভার মধ্যে পান। পচা-ভাঙা-মোটা-মিশালি মোটকথা যত খারাপ হোক কোন ক্ষেতি নাই। ফুড কমিটিতে পঞ্চাশ মণ খুব ভাল সরু চাউল আইছেহেইয়ার থেইকা পঁচিশ ত্রিশ মণ গোপনে সরাইয়া রাখছি, হেই চাউল পুরণ কইর‍্যা দিতে হইবব্যাপারটা এইবার বোঝলেন তো, কুণ্ডু মশাই।’ কথা শেষ হতেই লোকটার বীভৎস সর্বনাশা শয়তানির হাসির শব্দে ঘরটা ছমছম করতে থাকে। অপরদিকে শ্মশানের লোভী শেয়ালের মতো কান খাড়া করে শুনছিল কুণ্ডু মশাই। আর অর্ধচেতন চোখ কানকে কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছে না হাশিম; সারাদিন পশুর মতো পরিশ্রম আর উপোসে তবে কি জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছে সে? ক্ষুধিত অবসন্ন চেতনায় এক দারুণ অবিশ্বাস্য দুঃস্বপ্ন দেখছে। হঠাৎ তার মাথার রক্তে প্রবল জেদ চেপে যায়এই সন্দেহ তাকে দূর করতেই হবে। একটা অদ্ভুত উত্তেজনার হেঁচকা টানে চাঙা হয়ে ওঠে হাশিমের শরীরটামুহূর্তের প্রচণ্ড ধাক্কায় ভেঙে চৌচির হয়ে যায় তার এলিয়ে পড়া অবসন্নতা। খুঁটি ছেড়ে লাফিয়ে উঠে গদির কাছে ঘেষে দাঁড়ায় হাশিম। প্রদীপের আলোয় সত্যিই সে দেখতে পাচ্ছে সীরাজ মিয়াকে। এ তল্লাটের মুরব্বি মাতব্বর সীরাজ মিয়া, গরিবের আশ্রয় সীরাজ মিয়ার মুখ থেকে তখনো সেই শয়তানের হাসি একেবারে মিলিয়ে যায়নি। মসজিদে-বৈঠকে-জমায়েতে যাকে দেখে শ্রদ্ধায় সাহসে রোমাঞ্চিত হয়ে উঠত হাশিমের বুকরাত্রির ঠাসা অন্ধকারে প্রদীপের টিম টিমে আলোয় আজ তাকে দেখে অদ্ভুত রকম আঁতকে উঠল সে, ঘৃণায় যেন শরীরের সমস্ত রক্ত বিষিয়ে গেল তার। নিজের বিশ্বাসের উপর নিজেই মুহুর্মুহু নির্মম কঠোর চাবুক হানতে থাকে হাশিম! হাশিমকে দেখে সীরাজ মিয়া চমকে ওঠে। শ্রীনাথ কুণ্ডুকেও দারুণ অপ্রস্তুত দেখায়। একটু থতমত খেয়ে স্বাভাবিক হয়ে বলে‘কেয়ারার টাকা চাস, তা এতক্ষণ কছ নাই ক্যান?’ হাশিম বলে‘টাকা চাইমু ক্যান? চাউল দিবেন না কইছিলেন, ঢাল নিমু।’ কুণ্ডু গদাকে এক স্যার চাউল মাইপ্যা দিতে বলে। শুনে হাশিমের পা থেকে মাথা পর্যন্ত জ্বলে ওঠে—‘এক স্যার ক্যান? সোয়াস্যার দিবেন।’ কুণ্ডুর আগেই এবার কুকুরের মতো খেঁকিয়ে ওঠে সীরাজ মিয়া—‘এক স্যার নাতোরে কয় স্যার দিবরে শুয়ার?’ মাথার রক্ত আগুনের মতো গরম হয়ে ওঠে হাশিমেরঅসহ্য ক্রোধে মুহূর্তের মধ্যে যেন ফেটে পড়ে সমস্ত শরীরেকোটরাগত চোখ দুইটা অগ্নি স্ফুলিঙ্গের মতো ঠিকরে বেরিয়ে আসতে চায় তার। নিজের মধ্যে প্রবল শক্তি অনুভব করে আশ্চর্য হয়ে যায় হাশিম। হাশিমের ইচ্ছে করে বাঘের মতো এক লাফে গদিতে উঠে দোযখের শয়তান দুটোর ঘাড় মটকিয়ে আজ বাড়ি ফেরে সে। সীরাজ মিয়া, শ্রীনাথ কুণ্ডুর মতো অসংখ্য লেবাসধারী এবং মজুতদার ব্যবসায়ী দেশজুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। পঁচা-ভাঙা-মোটা-মিশালি মোটকথা যত খারাপ হোক না কেন, তাতে তাদের কোনো ক্ষতি নেই। সাধারণ মানুষকে ঠকিয়ে কয়েকগুণ মুনাফা অর্জনই যাদের মূল ধর্ম।

 

আবু ইসহাক (১৯২৬-২০০৩): শরীয়তপুরের নড়িয়া থানার শিরঙ্গল গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি কথাসাহিত্যিক ও অভিধানকারক। তিনি শুধু শরীয়তপুরের নন বাংলা সাহিত্য এবং বিশ্বসাহিত্যের একজন শক্তিমান লেখক। বলা চলে শরীয়তপুর জেলার গল্পচর্চার সমস্ত আলোই নিজের দিকে কেড়ে নিয়েছেন তিনি; শুধু তাই নয়শরীয়তপুরের গল্পচর্চার অতীত ও বর্তমানের ভাষাগত এবং বিষয়বৈচিত্র্যএই দুইয়ের মধ্যে সংযোগ স্থাপন করেছেন বলে মনে করি। বিখ্যাত ‘সূর্যদীঘল বাড়ী’ তার রচিত উপন্যাস। তার গল্পগ্রন্থগুলো হচ্ছে ‘মহাপতঙ্গ’ (১৯৬৩), ‘হারেম’ (১৯৬২), ‘গল্পসংগ্রহ’ (২০০৫)। এতে গল্প রয়েছে মোট ২১টি। সেখানে সমাজের নানাবিধ বিষয় তুলে ধরেছেন। সাহিত্যানুরাগী পাঠকই শুধু নয় সর্বস্তরের শিক্ষিত জনগণের কাছে তার গল্প সমান পরিচিত। কারণ দীর্ঘদিন ধরে তার দুটি গল্প জাতীয় শিক্ষাক্রমে পাঠ্য। এই শক্তিমান লেখকের গল্পের সাথে আমার পরিচয় যখন আমি অষ্টম শ্রেণিতে পড়ি। তার সব থেকে বিখ্যাত গল্প ‘জোঁক’ ছিল আমাদের পাঠ্য। জোঁক বাংলাদেশের অজপাড়াগাঁয়ের একটি অতি ক্ষুদ্র উভচর প্রাণী। শরীয়তপুরের একটি অন্যতম ফসল হচ্ছে পাট। বর্গাচাষি ওসমান বর্ষাকালে বুকসমান পানির জমিতে পাট কাটতে যায়। লুঙ্গিতে কাছা মেরে পানিতে ডুবে ডুবে পাট কাটতে কাটতে যখন ক্লান্ত তখন ছেলে তোতা ফেন নিয়ে যায় বাবার জন্য। ফেন দেখে খুশি হয় ওসমান। লবণ-মেশানো এক খোরা ফেন পানিতে দাঁড়িয়েই চুমুক দেয় ওসমান। শেষে কাটা পাট নৌকায় তুলে বাড়ির দিকে রওনা দেয় বাপবেটা। তোতা লগি চালিয়ে নৌকা বেয়ে নিয়ে চলে। হঠাৎ তোতা দেখে ওসমানের ডান পায়ের হাঁটুর উপর প্রায় বিঘতখানেক লম্বা করাতে জোঁক রক্ত খেয়ে ধুমসে উঠেছে। ‘জোঁকটা কতবড় বাপপুসরে’তোতা বলে ওঠে। ‘দুর বোকা! এইডা আর এমুন কী জোঁক। এরচে বড় জোঁকও আছে’ওসমান বলে। তোতার বড় জোঁক সম্পর্কে ধারণা না থাকলেও ওয়াজেদ চৌধুরী এবং তার ছেলে ইউসুফ সেই বড় ‘জোঁক’গল্প পাঠে সহজেই তার প্রমাণ পাওয়া যায়। যাদের রক্ত চুষে নিতে দেখা যায় না, আবার দেখা যায়। তারা আছে সব কালে সব সমাজে। এই জোঁকগুলো বিভিন্ন খোলসে সমাজে আমাদের সাথেই বসবাস করে থাকে। সমাজের পিছিয়ে পড়া, ভূমিহীন-নিরক্ষর মানুষদের ওই সকল জোঁকেরা ক্ষমতার পালাবদলে একের বদলে অন্য ফিরে এসে রক্ত চুষে খায়। তাই জোঁক গল্পটি এতটা প্রাসঙ্গিক। জোঁক গল্পের মতো আবর্ত গল্পেও তীব্রভাবে গ্রামীণ জীবন এবং উচ্চ শ্রেণি কর্তৃক নিম্ন আয়ের ভূমিহীন প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে নিষ্পেষণের চিত্র উঠে এসেছে।

‘দাদীর নদীদর্শন’ গল্পটি শুরু হয়েছে ঠিক এভাবেই—‘নদী যে-দেশের শিরা-উপশিরা, সে-দেশের অনেক মানুষ নদী দেখেনি।’ এই গল্পে যিনি নদী দেখেননি তিনি হলেন রাজাপুরের মীরহাবেলীর মৌলবি দাদি। ষাট বছরের ওপর বয়স দাদির পর্দানিষ্ঠার অনেক কাহিনী উপমা হিসেবে ব্যবহৃত হয়। বাড়ির বাইরে নদী দেখতে যাবেন তো দূরের কথা তিনি পঞ্চাশ বছরের মধ্যে ভুলেও একবার বাড়ির বৈঠকখানায় ঢোকেননি। অবশেষে নদী এসেছে তার সাথে দর্শন দিতে। দু মাইল দূরে ছিল যে পদ্মা, ভাঙতে ভাঙতে সে এখন মীরহাবেলীর কাছাকাছি এসে গেছে। সরিসৃপের মতো বুকে হেঁটে ক্রমেই এগিয়ে আসছে। দুশো বছরের পুরাতন জরাজীর্ণ হাবেলী পদ্মার শোঁ শোঁ আওয়াজ শুনে কাঁদছে থরথর করে। অবশেষে মীরহাবেলীর লোকজন উত্তরপাড়ে আশ্রয় নেয়। অবশেষে ডাক আসে দাদির। দরজার কাছ থেকে পালকিতে এবং পালকি সমেত পানসিতে ওঠেন দাদি। ভাদ্র মাসের ফুলে ওঠা ধু-ধু পদ্মা, খিড়কির পর্দা ফাঁক করে ঘোলাটে চোখে দেখেন দাদি। ভয় ও বিস্ময় তার চোখে-মুখে! আশপাশে ইলিশ মাছ ধরার নৌকা ঢেউয়ে দোল খাচ্ছিল। দোল খাচ্ছিল পানসি। একপর্যায়ে ঢেউয়ের দুলুনিতে বমি করে দেন দাদি। এটাই ছিল দাদির প্রথম ও শেষ নদী দর্শন। ‘দাদীর নদীদর্শন’ গল্পের পাশাপাশি ‘শয়তানের ঝাড়ু’ ও ‘বোম্বাই হাজি’ গল্পে গ্রামীণ সমাজজীবনের আড়ালে লুকিয়ে আছে ধর্মীয় গোঁড়ামি ও কুসংস্কারের জালে বন্দি আরেক জীবনের গল্প। ‘কালাভুনা’, ‘প্রতিষেধক’, ‘সাবীল’ ইত্যাদি গল্পেও ধর্মীয় কুসংস্কারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ও বিদ্রূপ উচ্চারিত হয়েছে। আবার এক প্রতারক দুধ-বিক্রেতার পিতৃস্নেহ জেগে ওঠার চমকপ্রদ একটি গল্প হচ্ছে ‘উত্তরণ’। অপরদিকে শহুরে নাগরিক জীবনের চাকচিক্যে, ভোগবিলাসিতার আড়ালে অন্তর্নিহিত যন্ত্রণা ও গ্লানি এবং নগর জীবনের মধ্যে লুকায়িত ভণ্ডামি ও শঠতার গল্প তুলে এনেছেন ‘বনমানুষ’, ‘প্রতিবিম্ব’, ‘বর্ণচোর’ প্রভৃতি গল্পে। ‘ঘুপচি গলির সুখ’ একটি ব্যতিক্রমী গল্প। গল্পের নায়ক হানিফ ৫৩ টাকা বেতনের চাকরি এবং কুঁড়েঘরে বসবাস করেও সুখী। কারণ মানুষের চাওয়া পাওয়ার শেষ নেই। পৃথিবীর অর্ধেক দিয়ে দিলেও সে খোঁজ করবেবাকি অর্ধেক কোথায়? তাই জীবনে সুখী হতে অনেক সাধ্য-সাধনা করে হানিফ আকাঙ্ক্ষা দমনের কৌশল আয়ত্ত করেছে। আবু ইসহাক একাধিক কৌতকপূর্ণ বিবরণ তুলে ধরেছেন। তার একটি উদ্ধতি এরকমপোলাও কোর্মা আমাদের পকেট খালি ও পেট খালাস করে দেয়। তাই ভেবে আমার স্ত্রী তা রাঁধতে শিখেনি। তবে গুড়ামাছ, শাক, ডাল আর ভাত রান্নায় সে দক্ষহস্ত। মিলের মোটা শাড়ি তালি দিয়ে দিয়ে পরতে সে অভ্যন্ত। স্বামীর খেদমতে সর্বক্ষণ ব্যস্ত, কারণ তার পায়ের তলায় নাকি বেহেশত। মাসের শেষের দিকে নুন-ভাত খেয়ে তৃপ্ত। মিতব্যয়িতার বৃদ্ধিতে দীপ্ত। ম্যালেরিয়া জ্বরে না হয় জব্দ। স্বামীর কট-কথায় না করে শব্দ।’

আবু ইসহাক-এর রূপকধর্মী এক আশ্চর্য ও কালউত্তীর্ণ গল্প হচ্ছে ‘মহাপতঙ্গ’। নবম-দশম শ্রেণিতে গল্পটি পাঠ্য। তাই ছাত্রজীবনেই পড়া হয়েছে। কিছু প্রাণীর অদ্ভুত রূপক নামের সাথে পরিচয় মেলে এই গল্প পাঠে। স্কুল শেষে বাড়ি ফিরে সমবয়সীদের জিগ্যেস করতাম—‘বল-তো কুণ্ডলী ফোঁসফোঁস কী? ভ্যাঁ-ভোম্বল, ম্যাও-খোক্কস কী?’ তারা হাঁ করে তাকিয়ে থাকত। যাই হোক, একটি বাড়ির দেয়ালের ফোকরে বাসকরা একজোড়া চড়ুই পাখিকে আশ্রয় করে এই গল্প বর্ণিত হয়েছে। চড়ুই পাখি মানুষকে বলে দো-পেয়ে দৈত্য আর উড়োজাহাজকে মহাপতঙ্গ। কী আশ্চর্য, মহাপতঙ্গকে দো-পেয়ে দৈত্য পোষ মানিয়েছে। মহাপতঙ্গ যখন আবারও আসে চড়ুই দুটো ভেবেছিল তারা মনে হয় আগের মতো খাবার বহন করে এনেছে। বাচ্চাদের আবদারে তারা মহাপতঙ্গ দেখতে ছুটে যায়। কিন্তু না এবার আর মহাপতঙ্গ খাবার আনেনি। এনেছে মারণাস্ত্র! বুম বুম শব্দে মহাপতঙ্গের পেট থেকে বোমা বের হয়। যদিও প্রথমটায় চড়ুই ভেবেছিল এগুলো মহাপতঙ্গের ডিম। ওরা জানত না এই ডিম থেকে বাচ্চা ফোটে না। এই ডিম সব ধ্বংস করে দেয়। হারিয়ে যায় চড়ুই দম্পতির বাচ্চা, সংসার। তাদের মুখ থেকে বেরিয়ে আসে ছি ছি ছি। এই ধিক্কার মানবজাতির জন্য। ‘মহাপতঙ্গ’ গল্পে বিজ্ঞানের আবিষ্কারকে ব্যবহার করে মানুষ কখনো প্রাণ বাঁচাতে আবার কখনো ধ্বংসলীলায় মেতে প্রাণ নিতে ছুটে যাওয়ার বর্ণনা চমৎকাররূপে উপস্থাপন করেছেন।

 

খুরশীদ আলম (১৯৫৫-২০০৮): জন্ম প্রিয়কাঠি, ডামুড্যা, শরীয়তপুর। গল্প দিয়ে খুরশীদ আলম-এর লেখালেখির যাত্রা শুরু। তার গল্পগ্রন্থ চারটি হচ্ছেশ্বেত কপোতের ডানা’, ‘হৃদয় নদীর রক্তপাত’, ‘প্রদীপ শিখায় অভিযান’ (২০০৬), ‘শিক্ষকের সমুদ্র যাত্রা’ (২০০৯)। শিক্ষকের সমুদ্র যাত্রা, প্রেমবতী পুরুষহীনা, চাষীর ভোট, মজুরি, বদলা, বিবমিষা, আশ্রয়, শব্দকূট, তিস্তায় খরদাহ, প্রযুক্তির দ্বন্দ্ব-তত্ত্ব, ধর্মের ভাই-এই ১২টি গল্প শিক্ষকের সমুদ্র যাত্রা গল্পগ্রন্থে স্থান পেয়েছে। প্রদীপশিখায় অভিযানে মোট গল্পের সংখ্যা ৮টি। গল্পগুলো হচ্ছে-পতাকা, বানরওয়ালা, খাঁচার পাখি, কাজললতা, তেভাগার নাতনি, শিশুর আকাশ, ক্রিকেট লড়াই এবং মায়ের মতো মেয়ে। গল্পগুলোকে কিশোর গল্পই বলা চলে। এর মধ্যে পতাকা, বানরওয়ালা, শিশুর আকাশ ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য গল্প।

‘পতাকা’ গল্পে ০২ মার্চ ১৯৭১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা ভবনে প্রথম পতাকা উত্তোলন করা হয়। সেই খবর দেশব্যাপী ছড়িয়ে পড়লে হেলাল-এর কনেশ্বর স্কুল ও বাজারে নতুন পতাকা উত্তোলন করে। হেলাল তা দেখে মহাখুশি হয়। তার বাড়িতে গাছের সাথে পতাকা উত্তোলন করে। এদিকে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। বাড়িতে পতাকা উত্তোলন করা ঝুঁকির বিষয়। পাকবাহিনীর আক্রমণ হতে পারে তবুও হেলাল পতাকা নামাবে না। সে মুক্তিযুদ্ধে যেতে চায়, কিন্তু বয়স না হওয়ায় যেতে পারে না। মুক্তিযুদ্ধে যেতে না পারলেও একদিন কাউকে কিছু না বলে মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্পে চলে যায়। মুক্তিযোদ্ধারা অপারেশনে গেলে হেলাল ক্যাম্প পাহারা দেয়। পতাকা এবং দেশের প্রতি একটি কিশোর ছেলের অকুতোভয় ও অকৃত্রিম ভালোবাসা পতাকা গল্পে প্রস্ফুটিত হয়েছে।

‘বানরওয়ালা’ গল্পে দেখতে পাই একটি কিশোরের বানরের মালিক বনে যাওয়া। গাছপালা উজাড় করে দেওয়ায় পরিবেশ এবং মানুষের জীবনের সম্ভাব্য বিপদের বিরূপ প্রতিক্রিয়ার হুঁশিয়ারি তুলে ধরেছেন এই গল্পে। মিলন তার মামার কাছ থেকে জেনেছে প্রকৃতি বিপন্ন হওয়ার মানে বন্যপ্রাণী ও মানুষ সবাই বিপন্ন। তাই রাস্তার পাশে পুরোনো গাছ বিক্রি করে দেওয়ায় মিলন এর প্রতিবাদ করে তার বন্ধু ও বানরের সাহায্যে। কিন্তু মিলন ব্যর্থ হয়। কারণ আইনের বইতে যা-ই থাকুক, ক্ষমতাধর ব্যক্তিদের কথা ও কাজই আসল আইন। ‘শিশুর আকাশ’ গল্পে আমরা দেখতে পাই আবির নামে একটি কিশোরযার বাবা ইতোমধ্যেই তাদের ছেড়ে চলে গেছে। মা গার্মেন্টসকর্মী। একদিন গার্মেন্টসটিতে আগুন লেগে তার মা-ও মৃত্যুবরণ করে। কিশোরটি তার মায়ের লাশের খোঁজে এবং পরবর্তীকালে সাহায্য ও কাজের আশায় বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে বেড়ায়। কিন্তু কাজ কিংবা সাহায্য কারও কাছ থেকে তো পায়ই না বরং ওর মায়ের জমানো টাকা ছিনতাইকারী নিয়ে যায়। ওর ছোট ভাইকেও ছেলে-ধরা ধরে নিয়ে যায়। পরবর্তীকালে আবির ওর বুদ্ধিমত্তার সাহায্যে টাকাই শুধু ফেরতই আনেনি ছিনতাইকারীদেরও ধরিয়ে দেয়। ওর ভাইকে খুঁজে না পেলেও যারা ধরে নিয়ে যায় তাদের পুরো গ্যাংদের সে ধরতে সহায়তা করে।

‘খাঁচার পাখি’ গল্পে শিবুর শখ বিভিন্ন ধরনের পাখি পালন করা। খাঁচায় আটকে থাকা পাখিদের ওর দেখতে ভালো লাগে। কিন্তু সে খাবারদাবার দিতে এবং যত্নাদি করতে একদমই কসুর করে না। তবে একদিন ওর বাবা জেলে বন্দি হলে বাবাকে দেখতে গিয়ে বুঝতে পারে খাঁচায় আটকে থাকা কী যন্ত্রণার! তাই পরবর্তীকালে সে বন্দি পাখিদের ছেড়ে দেয়। কাজললতা, তেভাগার নাতনী, মায়ের মতো মেয়ে গল্প তিনটিতে ধর্মীয় কুসংস্কার, গোঁড়ামি ও নারীর অধিকার ও নারীর স্বাধীনতার বিষয়ে সোচ্চার হতে দেখা যায়। অপরদিকে ক্রিকেট লড়াই গল্পটিতে দুটি গ্রামের কিশোরদের মধ্যে ক্রিকেট খেলা নিয়ে দ্বন্দ্বে গ্রামের লোক জড়িয়ে যায়। যাকে ভিলেজ পলিটিক্স বলতে পারি। যা গতানুগতিক। খুরশীদ আলমের অধিকাংশ গল্পকেই মনে হয়েছে একাধিক গল্পকে জোড়া দিয়ে একটি গল্প করা হয়েছে। পাশাপাশি কোথাও কোথাও স্ফীতভাবে উপস্থাপন হয়েছে বলে প্রতীয়মান হয়। তাই পড়তে গিয়ে কিছুটা ক্লান্তি লেগেছে। তবে তার গল্পগুলো কিশোর গল্প হলেও সর্বস্তরের পাঠকদের জন্য সমানভাবে পাঠযোগ্য এবং সর্বস্তরের পাঠকদের জন্যই কিছু না কিছু বার্তা রয়েছে।

 

সুলতান মাহমুদ (১৯৮৬): জন্ম ০৩ জুলাই চরআত্রা, নড়িয়া শরীয়তপুর। যে কজন গল্পকার বর্তমান সময়ে শরীয়তপুরে থেকে গল্পচর্চা করে যাচ্ছেন সুলতান মাহমুদ তাদের মধ্যে অন্যতম। তার প্রকাশিত গল্পগ্রন্থ চারটি। ‘বনফুল’ (২০১৪), ‘রক্তনদে লাল গোলাপ’ (২০১৬), ‘বরফকুমারী’ (২০১৮), ‘বিড়ালের ভবিষ্যৎ’ (২০২১)। এই চারটি বইতে মোট গল্পের সংখ্যা ৪৯টি। এর মধ্যে ‘বনফুল, মানুষ বড় স্বপ্ন সমান, খোকার বাড়ি ফেরা, মেহমান, ঘোলা জল, গাজার সকাল, একজন করিম মিয়া, গ্রিনকার্ড, ঝরে যাওয়া ফুল, ফেরা, তিস্তার বুকে শুকিয়ে যাওয়া স্বপ্ন, রক্তে নদে লাল গোলাপ, সাদের বিখ্যাত হয়ে উঠা, ফেল, টেম্পোর যাত্রী, বরফ কুমারী, সার্টিফিকেট, বাড়িওয়ালা, চোর, বিড়ালের ভবিষ্যৎ, চিঠি’ প্রভৃতি উল্লেযোগ্য গল্প।

‘ঝরে যাওয়া ফুল’ গল্পে শুভ্র ও মাহমুদ বন্ধু। শুভ্র খুবই মেধাবী। গ্রামের মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান। বাবা-মায়ের অনেক আশা-ভরসা ছিল শুভ্রকে নিয়ে। পড়ালেখা শেষ করে ভালো চাকরি করবে। সংসারের হাল ধরবে। তাই তো সন্তানকে শহরে পাঠিয়ে ভালো ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি করায়। শুভ্র ভালো স্টুডেন্ট হওয়ায় সহজেই চান্স পেয়ে যায়। পড়ালেখা ভালোই চলছিল। ভাবুক শুভ্র দেশ নিয়ে, দেশের সমস্যা নিয়ে এবং সমস্যা সমাধানের পথ বের করতে সবসময় ভাবতে থাকত। কিন্তু কিছুদিন পর শুভ্র আর শুভ্র থাকল নাখারাপ ছেলেদের পাল্লায় পড়ে নেশায় আসক্ত হয়ে পড়ে। পড়ালেখা আর শেষ করতে পারে না। বাবা-মায়ের স্বপ্নের ইতি ঘটে। গল্পের নাম থেকেই এর পরিণতি আঁচ করতে পারা যায়। এরকম অসংখ্য শুভ্রের পরিণতি হচ্ছে চোখের সামনে। গল্পকার এই করুণ পরিণতির জন্য আমাদের শিক্ষাব্যবস্থাকেই দায়ী করেছেন। গল্পটি নয়া দিগন্ত সাহিত্যপাতায় প্রকাশিত হয়।

‘ফেরা’ গল্পটি সুলতান মাহমুদের ‘রক্তনদে লাল গোলাপ’ গল্পগ্রন্থের আট নম্বর গল্প। এটি একটি অতিপ্রাকৃত গল্প। শরীয়তপুর জেলার লোকজন পদ্মা সেতু নির্মাণের পূর্বে প্রমত্তা পদ্মা নদী লঞ্চ, ট্রলার ও সী-বোটে পারাপার হতো। বর্ষায় পদ্মা ভয়ার্ত রূপ ধারণ করত। ফলে প্রতি বছর লঞ্চ, ট্রলার কিংবা সী-বোট ডুবে অসংখ্য লোকের সলিল সমাধি ঘটত। নাফিস নামে এক যুবক বিদেশ থেকে তার নিজ বাড়ি শরীয়তপুর আসার পথে মাওয়া ঘাটে এসে যখন পৌঁছে তখন অনেক রাত। লঞ্চ, ফেরি না পেয়ে একটা ট্রলার ভাড়া করে। পদ্মার মাঝখানে আসার পর একটি মেয়ের চিৎকার শুনতে পায়। মেয়েটি বাঁচাও বাঁচাও বলে চিৎকার করছিল। নাফিস চালককে ট্রলারটি থামাতে বলে। চালক বলেএত রাইতে এইখানে মানুষ আইব কইতননিশ্চয়ই কোনো ভূত পেতনি।’ নাফিজ চালককে ধমক দেয়। ট্রলার থামিয়ে টর্চের আলোতে খুঁজে পায় একটি মেয়েকেযে গাছের গুঁড়ি ধরে ছিল। কাছে গিয়ে মেয়েটিকে টেনে তোলে। মেয়েটিকে কাপড়চোপড় দেয় পরার জন্য। কিছু খাবারও খেতে দেয়। মেয়েটির নাম জুঁই। সাথে তার বোনও ছিল যাকে সে হারিয়ে ফেলেছে। একে একে মেয়েটি নাফিসের কাছে তার নাম ঠিকানা, বাবার নাম, তার স্বপ্নের কথা বলে। তার স্বপ্ন একটি হাসপাতাল করা। নাফিস যেহেতু বিদেশে থাকে তাই সে যেন তাকে হেল্প করে। গল্প করতে করতে এক পর্যায়ে দুজনেরই তন্দ্রা আসে। মেয়েটি ছইয়ের ভেতরে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়ে আর নাফিসও ঘুমিয়ে পড়ে। ফজরের পরে ট্রলার ঘাটে ভেড়ে। চালক নাফিসকে ডেকে তোলে। নাফিস উঠে ছইয়ের ভেতরে মেয়েটিকে না দেখে চালকের কাছে জানতে চায়ট্রলার ঘাটে ভেড়ার সাথে সাথেই মেয়েটি নেমে পড়েছে কিনা। চালক বলে, ‘না।’ তাহলে পানিতে ঝাঁপ দিয়েছিল কিনা? চালক বলে, ‘তাও তো দেখি নাই।’ ট্রলার থেকে নেমে মেয়েটির দেওয়া ঠিকানা মতো নাফিস তাদের বাড়ি যায়। মেয়েটির বাবা বলে তার দুই মেয়ে আজ থেকে দুই বছর পূর্বে প্রমত্তা পদ্মায় লঞ্চ ডুবে মারা গেছে। এরকম ঘটনা শুধু নাফিসের সাথেই প্রথম ঘটেনি আরও অনেকের সাথেই ঘটেছে বলে জানান জুঁইয়ের বাবা।

‘ফেল’ বিভিন্ন পাবলিক পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশের পর ঘটা কিছু চিত্র ফেল গল্পের বিষয়বস্তু। সজীব পরীক্ষায় ফেল করায় বাবা-মা তার সাথে কথা বলে না। আত্মীয়-স্বজনের বিদ্রূপ, সহপাঠীদের করুণ দৃষ্টি আর প্রতিবেশীদের বাঁকা হাসি সজীবের মনকে বিষিয়ে তোলে। বাড়ির পাশের পুকুরে যখন একটি শিশু পড়ে যায় এবং স্কুলের কক্ষে আগুন লাগে তখন কোনো মেধাবী ছাত্র তো এগিয়ে আসেনি? সজীবই এগিয়ে গিয়েছিল। এরকম অনেক কিছু সে ভাবতে থাকে। এরপর অভিমানে গলায় গামছা পেঁচিয়ে ঝুলে পড়ে ফ্যানের সাথে।

‘সাদের বিখ্যাত হয়ে উঠা’ গল্পে সাদ নামের ছেলেটা খুবই মেধাবী। সে ভর্তি হয় ইউনিভার্সিটিতে। সেখানে সে রাজনীতিতে জড়ায়। লেখকের ভাষায় এখন মেধাবীরা রাজনীতিতে আসে না। গল্পে বর্ণনাটি এরকমএখন সময় পাল্টেছে। নেতা হতে হলে চরিত্রবল বা মেধাবী নয় বরং হকিস্টিক ও হাতবোমার ব্যবহারে বিশেষ পারদর্শী হতে হয়। এখন ক্যান্টিনে খাবার বিল পরিশোধ না করে কিংবা বাসে ভাড়া না দিয়ে কন্ডাক্টরদের সাথে ঝগড়াঝাটি করে প্রমাণ করতে হয় তিনি ছাত্রনেতা। বক্তৃতা বিবৃতিতে গঠনমূলক কথা নয় বরং উঁচু গলায় ষাঁড়ের মতো চেঁচিয়ে প্রমাণ করতে হয় তিনিই বাগ্মী। চাঁদাবাজি, নেশা, জুয়াখেলা কিংবা মেয়েদের নিয়ে হলে রাত কাটানো এখন বড় ছাত্র নেতার বিশেষ গুণ হিসেবে ধরা হয়। বিপক্ষকে মোকাবেলায় মেধা কিংবা যুক্তি নয় বরং রড, চাপাতির ভাষায় কথা বলে তারা।’ পরীক্ষার তারিখ নির্ধারিত হলে ওপরে বর্ণিত গুণের ছাত্ররা সাদকে পরীক্ষা পেছানোর জন্য স্যারদের কাছে যেতে বলে কিন্তু সাদ রাজি হয় না। এই সামান্য কারণে ছাত্ররা সাদকে মেরে ফেলে। পরবর্তীকালে সাদের মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়ে দেশি-বিদেশি বিভিন্ন পত্রপত্রিকা ও ইলেকট্রনিক্স মিডিয়ায়। এটাই সাদের বিখ্যাত হয়ে ওঠা গল্পের মূল বিষয়। এরকম অসংখ্য ঘটনা আমরা দেখছি বর্তমানে বিভিন্ন ইউনিভার্সিটিতেসামান্য বিষয় নিয়ে অনেক মেধাবী ছাত্রকে জীবন দিতে হচ্ছে। এটা নতুন কিছু নয় আমাদের চোখের সামনে ঘটা গতানুগতিক পরিচিত একটা গল্প।

‘চোর’ গল্পে গ্রামের গোয়াল ঘরে একটি লোককে চুপটি করে বসে থাকতে দেখতে পাওয়া যায়। গ্রামটিতে কিছুদিন ধরে চোরের উৎপাত বেড়ে গিয়েছিল। মাঝে মাঝে গরু চুরি হচ্ছিল। লোকজন ভাবে লোকটা বুঝি গোয়াল ঘরে গরু চুরির জন্য ঘাপটি মেরে বসে আছেএকটু রাত বাড়লেই সে গরু নিয়ে চম্পট দেবে। লোকটাকে দেখে সবাই চিৎকার চেঁচামেচি শুরু করলে অনেক মানুষ জড়ো হয়ে যায়। টেনেহিঁচড়ে বের করে পঞ্চাশ-ঊর্ধ্ব লোকটিকে উঠানে মাড়াইয়ের কাঠের খামের সাথে বাঁধা হয়। একেকজন একেক রকম কথা বলে। শেষে সবাই মিলে বেধড়ক পিটিয়ে মারাত্মক রকম জখম ও আহত করে। লোকটা কিছু বলে না কিংবা পালানোর চেষ্টাও করে নাশুধু চেয়ে থাকে। গ্রামের পাশের কলেজে নতুন জয়েন করা শিক্ষক আসেন তার সহকর্মীকে নিয়ে ওই গ্রামে। মাদবর সাহেব তাদের পরিচয় জানতে চাইলে তারা পরিচয় দিয়ে বলেন—‘আপনাদের এখানে চোর সন্দেহে একজনকে ধরা হয়েছে শুনে এলাম। আমার বাবা মানসিক ভারসাম্যহীন যাকে আজ সন্ধ্যা থেকে পাচ্ছি না। আপনারা যাকে ধরেছেন তাকে একটু দেখতে চাই।’ ধৃত লোকটিকে দেখানো হলে শিক্ষক ‘বাবা’ বলে চিৎকার করে ওঠেন। ‘আপনারা একজন নিরপরাধ মানুষকে এভাবে মারলেন। সে তো বোবা, কথা বলতে পারে নাসে বোধটুকুও আপনাদের হলো না?’ মাদবর সাহেব ঘেমে ওঠে। কিছুদিন পূর্বে কোন এক স্কুলে ছেলে ধরা সন্দেহে এক নারীকে এভাবে পিটিয়ে মেরে ফেলা হয়। যখন তার ছোট্ট শিশুবাচ্চাটি বলেছিলতাদেরকে বলে দিও আমার মা ছেলে ধরা ছিল না’। তখন আমাদের কিছু বলার ভাষা ছিল না। বিড়বিড় করা ছাড়া যেমন মাদবর সাহেবেরও কিছুই বলার ছিল না! গল্পটির জন্য লেখক ‘পেন বাংলাদেশ পুরস্কার’ লাভ করেন। এছাড়াও তার ‘বরফকুমারী’, ‘সাদের বিখ্যাত হয়ে উঠা’, ‘ফেরা’ ও কীর্তিনাশার কাব্য’ বর্ষা সংখায় প্রকাশিত ‘আষাঢ়ে গল্প’ শীর্ষক গল্পগুলো চেতন-অবচেতনের মিশেলে ব্যতিক্রমধর্মী উপস্থাপনার জন্য অতিপ্রাকৃত ও পরাবাস্তববাদ গল্পের তালিকায় স্থান করে নিয়েছে।

 

রাজু আলাউদ্দিন (১৯৬৫): ০৬ মে নড়িয়া, শরীয়তপুরে জন্মগ্রহণ করেন। বেড়ে ওঠা ও পড়াশোনা ঢাকায়। তিনি কবি, প্রাবন্ধিক ও অনুবাদক। দেশি ও বিদেশি সাহিত্য নিয়ে নিয়মিত লেখার পাশাপাশি ইংরেজি ও স্প্যানিশ থেকে প্রচুর অনুবাদ করেছেন। তিনি বর্তমান সময়ে বাংলা সাহিত্যের অন্যতম প্রাবন্ধিক ও অনুবাদ হিসেবে সুপরিচিত। মৌলিক ও অনুবাদ মিলে তার প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা ৫০-এর ওপরে। এর মধ্যে সম্পাদনা ও সংকলন ‘হোর্হে লুইস বোর্হেস: নির্বাচিত গল্প ও প্যারাবল’ (২০১০) ঐতিহ্য থেকে এবং অণুগল্প ‘একিলিসের আদর্শ’ (২০১৯) বাতিঘর থেকে প্রকাশিত হয়। গ্রন্থ দুটি অনুবাদে তিনি মুনশিয়ানা দেখিয়েছেন, ফলে গ্রন্থ দুটি ব্যাপক আলোচিত ও প্রশংসিত হয়।

 

রাজু আলীম (১৯৬৮): ০৫ মার্চ শরীয়তপুর জেলার পালং থানায় জন্মগ্রহণ করেন। তিনি মূলত কবি ও টিভি অনুষ্ঠান নির্মাতা। কবি আল মাহমুদ, কবি শামসুর রাহমান ও কবি সৈয়দ শামসুল হকের জনপ্রিয় গল্পের পাশাপাশি নিজের অনেক গল্পে নাট্যরূপ দিয়েছেন। প্রকাশিত একমাত্র গল্পগ্রন্থ ‘আহ্! প্রজাপতি’ অনেক আগে প্রকাশিত হয়েছে। নিয়মিত তার গল্প বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হলেও দ্বিতীয় কোনো গল্পগ্রন্থ প্রকাশিত হয়নি। তার অধিকাংশ গল্প রোমান্টিক ধাঁচের। সমকালীন যাপিত জীবনের আলেখ্য, পাশাপাশি নগর জীবনের নানা টানাপোড়েন উঠে এসেছে তার গল্পে। উল্লেখযোগ্য রোমান্টিক গল্পসোনালি পূর্ণিমা, গোপন প্রেমিক, চাঁদবালিকার সঙ্গে, নীলিমা’র নীল আকাশ, আকাশকন্যা, পতেঙ্গার ঘোড়া। পতেঙ্গার ঘোড়া গল্পের জন্য পেয়েছেন সুনীল সাহিত্য পুরস্কার।

 

আব্দুল করিম বেপারী (১৯৫৫): ০৬ জুলাই শরীয়তপুর জেলার ভেদরগঞ্জ থানায় জন্মগ্রহণ করেন। তিনি মূলত মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক লেখালেখি করে থাকেন। তার একমাত্র গল্পগ্রন্থ ‘একাত্তরের খণ্ডচিত্র’। গ্রন্থটিতে মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক বারোটি গল্প স্থান পেয়েছে। গল্পগুলো হচ্ছেহুইশেল, বাঙালি, গেরিলা, ধ্বংস, আজও থামেনি, নয়ন, ময়নার মন, কুপোকাত, কষ্ট, দেখা, বিরাগ, রোখসানা। গল্পগুলোতে মুক্তিবাহিনীর বিভিন্ন গেরিলা অভিযান, পাক হানাদার কর্তৃক শরীয়তপুরের বিভিন্ন স্থানে আক্রমণও এর আগে-পরের বিভিন্ন তথ্য উঠে এসেছে।

 

খায়রুননেসা রিমি (১৯৭৬): শরীয়তপুর জেলার সুখিপুর থানার চরভাগা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি শিশু-কিশোর উপযোগী ও বড়দের উপযোগী উভয় ধরনের গল্প লিখতেই সিদ্ধহস্ত। তার শিশুতোষ গল্পগ্রন্থগুলো হচ্ছেচুল্লাবুড়ির খপ্পরে' (২০১৪), ‘ভূত ছানার বিদ্যা অর্জন’ (২০১৫), ‘এলিয়েনের মন খারাপ’ (২০২৪), ‘ক্লিন ভূতের কাণ্ড’ (২০২৪), ‘পরিদের পাঠশালা’ (২০২৪)। ‘তড়কন্যা লীলাবতী’ (২০১৯) তার কিশোর গল্প। ‘নষ্ট দিনের কষ্ট স্মৃতি’ (২০০৫) ‘ক্ষয়ে যাওয়া প্রেম’ (২০২৩) ও ‘শখের পুরুষ’ (২০২৫) রোমান্টিক ধাঁচের গল্প। তিনি এসময়ের শরীয়তপুর জেলার অন্যতম নারী গল্পকার।

 

কামরুল হাসান (১৯৬১): জন্ম ভেদরগঞ্জ, শরীয়তপুর। বসবাস ঢাকায়। তিনি মূলত কবিতা ও ভ্রমণকাহিনী লেখক। তার একমাত্র গল্পগ্রন্থ ‘মধ্যবিত্ত বারান্দা ও অন্যান্য গল্প’ ২০০৫ সালে প্রকাশিত। তার গল্পে মধ্যবিত্ত জীবনের জীবনঘনিষ্ঠ বিভিন্ন কাহিনী উঠে এসেছে।

 

তৌহিন হাসান (১৯৭৮): জন্ম শরীয়তপুর জেলার নড়িয়া থানার ভোজেশ্বরের বনের বাড়ি গ্রামে। পড়েছেন চারুকলা অনুষদের ড্রইং অ্যান্ড পেইন্টিং বিভাগে। নিউ ইয়র্কে অনুষ্ঠিত ‘অলিম্পিকস অব আর্ট ২০২৪’ অনুষ্ঠানে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করেন তিনি। চিত্রশিল্পী হলেও বিভিন্ন বিষয়ে লেখালেখি করে থাকেন। ২০০৬ সালে প্রকাশিত ‘রাষ্ট্রের ঘুণপোকা ও বিবিধ ঝিঁঝি’ তার প্রথম গল্পগ্রন্থ। ১২টি গল্প স্থান পেয়েছে গ্রন্থটিতে। উল্লেখযোগ্য গল্প‘পুরানো ফেরি নতুন সেতু, রাষ্ট্রের ঘুণপোকা ও বিবিধ ঝিঁঝি, মৃদুলকান্তি সাহা ধর্মান্তরে ক্রিশ্চান হলে সে ও তার পরিবার, রূপার মুদ্রা, মইনুদ্দিন পাগলঘটিত একটি মৃত্যুর কারণ ও ফলাফল’ প্রভৃতি। গল্পগুলো নিরীক্ষাধর্মী। ‘পুঁজিবাদী বিড়াল’ নামের তার দ্বিতীয় গল্পগ্রন্থ ২০২৫-এর বইমেলায় প্রকাশিত হয়েছে। এখানে স্থান পেয়েছে মাত্র ৬টি গল্প। কিন্তু গল্পগুলো অনেক দীর্ঘ এবং সমসাময়িক।

 

এছাড়াও শরীয়তপুরের যে সকল লেখক গল্পচর্চা করে যাচ্ছেন তারা হলেনমির্জা হজরত সাঁইজি, প্রকাশিত শিশুতোষ গল্প ‘মানিক ও কাকের গল্প’ (২০২৩); খান নজরুল ইসলাম-এর ‘ভালোবাসার সুখ স্মৃতি’ (২০০২); সফিক রহমানের ‘সূর্যের সমুদ্র স্নান’; মানিক লাল সাধুর ‘আনন্দ বনের রাজা’ (২০১৯), ‘টিয়া পাখির বিয়ে’; নকিব মাহমুদ ‘মেনগ্রিয়ার মোট পরি’ (২০১৮)। গল্পচর্চা করেন কিন্তু বই প্রকাশিত হয়নি এদের মধ্যে রয়েছেনশ্যামসুন্দর দেবনাথ (‘অতৃপ্ত আবেগ’ নামে শিশুতোষ পাণ্ডুলিপি আগুনে ভস্মীভূত), খান মেহেদী মিজান, দেওয়ান আজিজ, নজরুল ইসলাম শান্তু, ইব্রাহিম খলিল, মোদাচ্ছের হোসেন বাবুল, সালেহ আহম্মেদ, হোসাইন মুহা. দেলোয়ার, রফিক ওসমান, ফকির শাহিন শাহ, হোসাইন মোহাম্মদ আরিফ, খাদিজা বেগম কান্তা, সুদর্শন বাছার প্রমুখ। সাহিত্যের ছোটকাগজ ও বিভিন্ন দৈনিকে তাদের গল্প প্রকাশিত হচ্ছে। আমি নিজেও (ইয়াসিন আযীয) একজন গল্প লেখক। দৈনিক প্রথমআলো, দৈনিক অধিকার নিউজ, দৈনিক রুদ্রবার্তা, দৈনিক সুবর্ণগ্রাম, ছোটকাগজ ‘ঢেউ' ও ‘সমুদিত’, ‘দর্পণ’ অনলাইনে আমার গল্প প্রকাশিত হয়েছে।

 

শরীয়তপুরের সাহিত্যিকদের গল্পচর্চার ইতিহাস পর্যালোচনায় দেখা যায়স্বর্ণকমল ভট্টাচার্য, সাবিত্রী রায় ও রথীন্দ্রকান্ত ঘটক চৌধুরীর গল্পের ভাষা ও বিষয়-বৈচিত্র্য প্রায় কাছাকাছি। তিন জনের গল্পেই ভয়ংকর দুর্ভিক্ষ বা মন্বন্তর, মানবাধিকার লংঘন, দাঙ্গা, স্বাধীনতা লাভ, দেশভাগ প্রভৃতির বর্ণনা রয়েছে। সাবিত্রী রায়, রথীন্দ্রকান্ত ঘটক চৌধুরী দুজনের গল্পেই কলকাতার দুর্ভিক্ষের বর্ণনা পাই। তিনজনের জন্মস্থান ও জন্মসাল খুবই কাছাকাছি হওয়ায় তাদের দেখার চোখ ও সময় একই। আবু ইসহাক আগের তিনজনের সাথে বর্তমানের মাঝে সংযোগ স্থাপন করেছেন। আবু ইসহাক-এর বিষয়বস্তুতে আগের তিনজনের সাথে মিলের পাশাপাশি ধর্মীয় কুসংস্কার, ধর্মীয় গোঁড়ামির বর্ণনা ও খুরশীদ আলম-এর গল্পে এই দুইয়ের পাশাপাশি নারীর অধিকার এবং নারীর স্বাবলম্বিতার প্রতি জোর দিয়েছেন। রাজু আলাউদ্দিনের অনুবাদ গল্প পাঠককে অন্য ভাষার গল্পের সাথে পরিচয় করিয়ে দেয় এবং রাজু আলীম রোমান্টিক গল্পের ভাণ্ডারকে করছেন সমৃদ্ধ। কামরুল হাসানের গল্পে মধ্যবিত্তের যাপিত জীবনকে তুলে ধরেন। সুলতান মাহমুদ সময়ের ঘটে যাওয়া, হৃদয়ে দাগকাটা ঘটনাকে গল্পের মাধ্যমে তুলে ধরেন। খায়রুননেসা রিমি, শ্যামসুন্দর দেবনাথ, মির্জা হজরত সাঁইজি, দেওয়ান আজিজ, মানিক লাল সাধু শিশু-কিশোর গল্পকে সমৃদ্ধ করে চলছেন।

 

তথ্যসূত্র:

বিস্মৃতপ্রায় কথাসাহিত্যিক স্বর্ণকমল ভট্টাচার্যনির্মল বর্মন, জ্বলদর্চি অনলাইন।

বিপ্লব আর দেশভাগ জীবন্ত তার কলমেশিশির রায়, আনন্দবাজার অনলাইন।

আবু ইসহাকের গল্প: ডুবুরির কৌতুকপূর্ণ চোখ, আহমাদ মোস্তফা কামাল।

কবি ও কবিতা শরীয়তপুর, শ্যামসুন্দর দেবনাথ (সম্পাদনা)

সংসদ বাংলা সাহিত্যসঙ্গী, শিশির কুমার দাশ (সম্পাদনা)

কীর্তিনাশার কাব্য (বিভিন্ন সংখ্যা)

সববাংলা অনলাইন পোর্টাল

বি: দ্র: লেখাটি শফিক  হাসান সম্পাদিত 'প্রকাশ' নবম সংখ্যায় জেলাভিত্তিক গল্পচর্চার ইতিহাস: ১ম পর্বে প্রকাশিত হয়।

Post a Comment (0)
Previous Post Next Post